নিজস্ব প্রতিবেদক।
মাছের পোনা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেওয়া সাগরে অবরোধে আসলে কি সুফল আসছে? নাকি উল্টো হিতে বিপরীত হচ্ছে’ বিষয়টি নিয়ে চলছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চুল চেরা বিশ্লেষণ।
এর সূত্র ধরে সরজমিন উপকূলীয় এলাকার নদী ও সাগরের মোহনায় দেখা মেলে অজস্র ফিশিং বোটের। কর্তৃপক্ষের ধান্দাবাজির কারণে অবরোধ বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সাগরে ৬৫ দিনের অবরোধ নিয়ে চলছে মৎস্য অধিদপ্তর ও প্রশাসনের নাটকীয় কার্যক্রম। প্রতিদিন জেলার উপকূলীয় এলাকার বেশকিছু ফিশিং বোট সাগরে মাছ ধরে থাকেন এমন তথ্য উঠে এসেছে। অবরোধেও বাজারে মিলছে বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ।
নিষেধাজ্ঞা শুধু কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ , বাস্তবে ভিন্ন রূপ সর্বত্র।
মাঝেমধ্যে অভিযান চললেও তা শুধু লোক দেখানো, আর দায় সারতে মিডিয়া প্রকাশের লক্ষ্যে’এমনই মন্তব্য সচেতন মহলের।
প্রকাশ্যে চলছে সামুদ্রিক মাছ আহরণ, বাজারজাত ও অবাধ বিক্রি গ্রাম ও শহরাঞ্চলে। এমনকি বরফকল বন্ধ রাখার নির্দেশনা থাকলেও বন্ধ নেই, চলছে মাসোহারা দিয়ে। এসবের পিছনের গল্পটাই টাকার সুগন্ধে ভরা। যার দরুণ বাজার সয়লাব সামুদ্রিক মাছে।
স্থানীয় অধিকাংশ জেলেদের অভিযোগ, এ ধরনের অবরোধে সুফল পাচ্ছে না জেলেরা, ওইসময়ে বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকে ভারত ও মায়ানমারের জেলেরা মাছ ধরে নিয়ে যায়।
ফলে যে উদ্দেশ্য অবরোধ দেওয়া হয় তা অনেকটা অকার্যকর। তবে এ অবরোধ কে কেন্দ্র করে সংশ্লিষ্ট অসাধু কর্মকর্তাদের পকেট ভারী হচ্ছে এমনটা জানান ভুক্তভোগী জেলেরা।
জেলার উপকূলীয় এলাকায় নৌ-পুলিশ ও কোস্ট গার্ড থাকলেও সাগরে চলছে মাছ ধরা। তাতেই সমালোচিত হচ্ছে তাদের কার্যক্রম। পেকুয়ার উজান টিয়া ও কুতুবদিয়া দ্বীপ সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের মোহনায় দেখা মেলে বেশকিছু ফিশিং বোট। এ ছাড়াও মহেশখালীর দক্ষিণে বাকখালীর মোহনায় মাছ ধরার বোট দেখেছেন এমনই তথ্য দেন অনেকেই। এ ছাড়াও কুতুবজোম ঘটিভাঙা এলাকা থেকে প্রতিনিয়ত ফিশিং বোট যাচ্ছে সাগরে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বদরখালী ইউনিয়নের একজন জেলে জানান – বদরখালীর অধিকাংশ ফিশিং বোট নৌ পুলিশ ও কোস্ট গার্ডের সাথে আঁতাত করে বর্তমানে সাগরে রয়েছে, ওইসব বোট মাতারবাড়ী পশ্চিমে ও কালারমারছড়া ঘাটে মাছ বিক্রি করে আবার সাগরে মাছ ধরতে যায়। এ ছাড়াও বাজার মনিটরিং এ উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ হতে ও তেমন কার্যত কোন পদক্ষেপ লক্ষণীয় নয় বলে দাবি করেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। বাজারে মাঝেমধ্যে মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হলেও ঠিকই চলছে মৎস্য আহরণের কাজ। অবরোধে কিভাবে সাগরে মাছ ধরা হচ্ছে তা জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কিছু জেলে জানান টাকার লেনদেনের কথা।
এ ছাড়াও সড়ক পথে মাছ বিভিন্ন শহরে নিয়ে যাওয়ার সময়েও টাকার বিনিময়ে সববাঁধা অতিক্রম করে পৌঁছে যায় গন্তব্যে। এই অবরোধ কে পুঁজি করে কোটি কোটি টাকার লেনদেনে ব্যস্ত সংশ্লিষ্টরা।
মৎস্যজীবীরা বলছেন-এভাবে অবরোধ দিয়ে কোন লাভ নেই, অবরোধের অজুহাতে মৎসজীবীদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। অনেকটা অকার্যকর নামমাত্র অবরোধ চলতে থাকায় অহেতুক তাদেরকে এই অবরোধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে’এমনই জানান জেলেরা। আর এর ফলে সুবিধা নিচ্ছে পার্শবর্তী দেশগুলো। যার ফলে এ অবরোধ মানতে নারাজ জেলেরা।
অবরোধ শুরুতে বৈরী আবহাওয়ার কারণে জেলেদের মাছ ধরা বন্ধ ছিল কয়েক দিন। আবহাওয়া স্বাভাবিক হলে জেলেরা সাগরে চলে যায় প্রশাসন ম্যানেজ করে। এসব মাছ ট্রাক,পিকআপ যোগে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত করা হচ্ছে প্রকাশ্যেই। এসব চলছে প্রশাসনের সামনেই। তবে মাছ ব্যবসায়ীরা কর্তৃপক্ষকে টাকা না দিলে মাছের গাড়ি আটক করেন এমনই তথ্য উঠে এসেছে।
গতকাল মাতারবাড়ী নৌ পুলিশ বদরখালীর পাঁচ’টি ফিশিং বোট আটক করেন বলে জানান বোট মালিক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন জেলে জানান -চুক্তি ভিত্তিক টাকা না দিলে বোট আটক করেন নৌ-পুলিশ/ কোস্ট গার্ড। তবে দায় কেউ নিতে চায় নি।
এ অবস্থায় সাগরে অবরোধ নিয়ে প্রশাসনের পরস্পর বিরোধী বক্তব্যে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে জনমনে। এতে সরকারের মৎস্য প্রজনন বৃদ্ধির প্রকল্প ভেস্তে যাচ্ছে বলে মনে করেন অনেকেই। সাগরে মৎস্য সম্পদ বৃদ্ধিতে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে জেলেদের প্রণোদনা, নৌ-পুলিশ, কোস্টগার্ড, মৎস্য বিভাগকে ঢেলে সাজালেও তা কোনো কাজে’ই আসছে না। উল্টো সরকারি সিদ্ধান্ত কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মৎস্য সম্পদ রক্ষায় নিয়োজিত সংস্থাগুলো প্রজনন বৃদ্ধিতে সহায়তা না করে অবরোধেও মাছ ধরার সুযোগ দিয়ে ধান্দায় লিপ্ত হয়ে পড়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই সাগরের মৎস্য সম্পদ বৃদ্ধি ও রক্ষায় ৬৫ দিনের অবরোধসহ কয়েক দফায় অবরোধ কর্মসূচি হাতে নেয় সরকার। মাছের নিরাপদ প্রজনন ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে এই কর্মসূচি শুরু হয় ২০১৫ সালে। শুরুতে শুধু ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রলালের আওতাভুক্ত ছিল অবরোধ। পরবর্তী ২০১৯ সালে মাছ ধরার সকল নৌযানকে এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হয়।
প্রশাসন ম্যানেজ করে নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেরা দেন ভিন্ন তথ্য। তারা বলছেন, সমুদ্রে অবরোধ চলাকালীন পার্শ্ববর্তী দেশের জেলেরা বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশ করে মাছ ধরলেও প্রশাসনের কোনো পদক্ষেপ নেই।
ফলে জেলেরা মাছ শিকারে যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে প্রশাসনের নজরদারি থাকলে বাংলাদেশের জেলেদের মধ্যেও অবরোধ পালনে আগ্রহ তৈরি হতো এবং সুফল আসতো। সমুদ্র সীমার পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে মিল রেখে অবরোধ কর্মসূচি দেওয়া হলে এর সুফল পাবে জেলেরা।ইতিপূর্বে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি মহলকে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে সমুদ্রে মাছ শিকারের সুযোগ করে দিতে ছোট-বড় ট্রলার প্রতি বেঁধে দেওয়া হয়েছিল নির্ধারিত হারে টাকা। তবে চলতি বছরে এর পরিমাণ আরো বৃদ্ধি করা হয়েছে।
সচেতন মহলের প্রশ্ন :
প্রশাসনের সাথে আতাঁত না করে তাহলে কিভাবে অবরোধের শুরু থেকেই প্রকাশ্যে জেলেরা মাছ ধরছেন?
এসব নিয়ে কেউ ভয়ে গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে কেউ কথা বলতে রাজি নয় ভয়ের কারণে।
যুগ যুগ ধরে পেশার সঙ্গে যুক্ত থেকেও নিবন্ধনের আওতায় না আসায় সরকারি সহায়তা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। আবার দেখা গেছে, অনেকেই স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছের লোক হওয়ায় জেলে না হয়েও সরকারি সুবিধা ভোগ করছে। এতে প্রকৃত জেলেরা সুবিধা বঞ্চিত হচ্ছেন।তবে প্রশাসন ও মৎস্য বিভাগ অবরোধ নিয়ে কঠোর অবস্থানের কথা জানালেও বাস্তবে ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে।
এ বিষয়ে বদরখালী নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মফিজুর রহমান বলেন, আমরা কঠোর নজরদারী ও অভিযানের কারনে অনেকে আমরা টাকা নিচ্ছি বলে অপপ্রচার চালাচ্ছে, টাকা নেওয়ার বিষয়টি অপপ্রচার। আর বাজারে সামুদ্রিক মাছ বিষয়ে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা’কে জানাতে পারেন এমনই জানান তিনি। তাঁরা আমাদের ডাকলে আমরা অভিযানে যাব।
এ বিষয়ে মাতারবাড়ী নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মাঈনুলের ০১৭৬৩২১৭২৫২ নাম্বারে ফোন করলেও রিসিভ না করায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে কক্সবাজার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বদরুজ্জামান বলেন, মহেশখালী চকরিয়া ও কুতুবদিয়া উপকূলে এখনো বোটে মাছ ধরতেছে এটি আমি জানিনা। আমি উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাদের বিষয়টি নজরে এনে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলে দিবেন। তবে অবরোধেও সাগরে মাছ ধরা অব্যাহত থাকায় কর্তৃপক্ষের ভুমিকা প্রশ্নের সম্মুখীন। আসলে নামসর্বস্ব এই অবরোধ কতোটা সুফল আসছে এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে জনমনে।