অদম্য পরিশ্রম আর সাহসিকতা নিয়ে গ্রামীন সংস্কার আর প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে ডেইরি ফার্ম করে একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন মৌলভীবাজার কমলগঞ্জে মেহেরুন্নেছা। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ডেইরি আইকন স্বীকৃতি পুরস্কার এক লক্ষ টাকাও তিনি পেয়েছেন।
গৃহবধু মেহেরুন্নেছা সংসার সামলানোর পাশাপাশি স্বামী ও শ্বশুরের অনুপ্রেরণায় বাড়ীর পাশেই ২০১৪ সালে গড়ে তুলেন এক গরুর খামার। শুরতে ১২টি গরু নিয়ে যে স্বপ্নের যাত্রা শুরু হয়েছিলো, তা আজ বিশাল কর্মক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ মিলনায়তনে বিশ্ব দুগ্ধ দিবস ২০২৩ উদযাপন ও ডেইরি আইকন সেলিব্রেশন অনুষ্ঠানে ডেইরি আইকন হিসেবে ‘ডেইরি ক্যাটাগরি’তে পুরস্কার পায় মেহেরুন্নেছা বেগমের ডেইরি ফার্ম। পুরস্কারের আর্থিক মূল্য এক লাখ টাকাও ক্রেস্ট সনদ পেয়েছেন৷
কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুরের নৈনারপার বাজারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী খতিব মিয়ার মেয়ে মেহেরুন নেছা। ২০০২ সালে স্নাতক সম্পন্ন করার পর জালালপুরের হাজী আসদ্দর আলীর ছেলে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হানিফুর রহমান বেলালের সাথে বিয়ে দেন। বিয়ের পর স্বামী,শ্বশুর-শাশুড়ী,ভাসুর ননদদের উৎসাহে মেহেরুননেছা বেগম পা রেখেছিলেন নতুন সংসারে। সংসারটা একটু গুছিয়ে নেওয়ার পর ঘররান্নার পাশাপাশি গড়ে তুলেন গরুর খামার। উৎসাহ যোগান স্বামী হানিফুর রহমান। সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হানিফুর রহমান হাজারো ব্যস্ততার কারণে সময় দিতে পারেন না স্ত্রীকে। মেহেরুননেছার স্বপ্নযাত্রায় অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেন শ্বশুর হাজী আসদ্দর আলী। দুই ভাসুর আলতাফুর রহমান ও আলাল মিয়া ভাতৃবধূর কর্মযজ্ঞে সঙ্গী হন।
২০১৪ সালে ১২টি গরু নিয়ে যে স্বপ্নের যাত্রা শুরু হাওয়ার পর শাহজালাল ইসলামি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কেনেন আরও ১৯টি গরু। তারপর এগিয়ে চলে তার স্বপ্নযাত্রা। স্বামী, শ্বশুর ভাসুররা তো সঙ্গেই আছেন- মেহেরুননেছা তার এ স্বপ্নের সাথে জড়িয়ে রেখেছেন তার শাশুড়িকেও। খামারের নামের সাথে যুক্ত করেছেন শাশুড়ির নাম। রহমান মরিয়ম (আরএম) ডেইরি ফার্ম অ্যান্ড অ্যাগ্রো ফিসারিজের মরিয়ম হচ্ছেন তার শাশুড়ি।
আরএম ডেইরি ফার্ম অ্যান্ড অ্যাগ্রো ফিসারিজের ধীরে ধীরে খামারের পরিসর যখন বাড়তে থাকে তখন বাড়তি লোকবলের প্রয়োজন দেখা দেয়। লোকবল নিয়োগে স্থানীয় বেকার যুবকদের প্রাধান্য দেওয়া হয়। সকলের পরিশ্রমে সাফল্যের পথে হাঁটতে থাকে আরএম ডেইরি ফার্ম। ২০১৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৮ বছরে খামারটি পরিণত হয় একটি আদর্শ খামারে। উৎপাদন বাড়ে, গরুর সংখ্যা বেড়ে যায় দেড় শতাধিক। উৎপাদন বাড়ার সাথে সাথে খামারের পরিসরও বাড়ে। গরুর খামারের সাথে যুক্ত হয় মাছের খামারও। ফলের বাগানও যুক্ত হয় খামারের পরিসরে।
আরো এগিয়ে যাওয়ার এ যাত্রায় সঙ্গী হয় পূবালী ব্যাংকও। খামারের ঋণের উপর ভর করে আরও দুইটি শেড নির্মাণ করেছে খামারে। পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়েই তৈরি করা হয় অবকাঠামো। শেডগুলোর পানি নিস্কাশন ব্যবস্থা, গরু বাছুরের খাবারের সুবিধা, বিশ্রামের জন্য পর্যাপ্ত পরিসর এবং বেলা শেষে মুক্ত পরিবেশে গোচারণের ব্যবস্থা রয়েছে এই খামারে। যা গরুগুলোকে সুস্থতায় বেড়ে উঠতে সহায়তা করছে। খামারের দক্ষিণ সীমানায় নির্মাণ করা হয়েছে আধুনিক সুবিধা সংবলিত দ্বিতল ফার্ম হাউজ। ফার্ম ব্যবস্থাপনা কার্যালয়, রেস্ট হাউজসহ নামাজের স্থান রাখা হয়েছে এখানে।খামারে রয়েছে ৩টি পুকুর। যাতে মাছ চাষ করা হয়। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বাকিটা বিক্রিও করা হয়। পুকুর পাড়ে নারকেল, সুপারি, লেবু, পেয়ারা, আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল নানা জাতের ফলদ গাছ লাগানো হয়েছে। বিশেষ করে চলতি মৌসুমে পুকুরপারে পরীক্ষামূলকভাবে ড্রাগন ফলের চাষ করে আশাতীত ফলন মিলেছে। খামারের ভেতরে বনজ বৃক্ষও রোপণ করা হয়েছে। পুকুর পাড়ের একটি ঘরে পরীক্ষামূলকভাবে পালন করা হচ্ছে কবুতর। আছে তিতির, টার্কিও। বর্তমানে খামারটি থেকে প্রতিদিন গড়ে ৬শ থেকে ৭শ লিটার দুধ উৎপাদন হয়। পাশাপাশি মাংসের যোগানও দেয় খামারটি। ফার্মের স্বত্বাধিকারী মেহেরুন নেছা বেগম বলেন এ সাফল্য শুধু আমার একার নয়। আমার খামারের সাথে জড়িত প্রত্যেকেই এ সাফল্যের সমান অংশীদার। তিনি বলেন, একটি বাড়ি একটি খামার’প্রকল্পের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েই আমি এ খামার প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হই।
নিজেকে স্বাবলম্বী করার পাশাপাশি কিছু মানুষের জীবিকার সংস্থান করতে পারছি এটাই আমার বড় পাওয়া। সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হানিফুর রহমানের স্ত্রী মেহেরুন নেছা বেগম বলেন, আমার স্বামী তার কর্মব্যস্ততার ফাঁকেও আমাকে সহযোগিতা করে চলেছেন। আমার শ্বশুর-ভাসুররা আমাকে সাহস না যোগালে আমার একার পক্ষে এতদূর এগিয়ে আসা সম্ভব হত না।