————
একজন শিক্ষার্থীর ইউনিভার্সিটিতে পড়ার ইচ্ছা জাগ্রত হয় সাধারণত স্কুলের শেষের দিকে । যে ডাক্তার হতে চায় সে পড়বে বিজ্ঞান বিভাগে, যে ব্যাংকার কিংবা দক্ষ ব্যবসায়ী হতে চায় সে পড়বে ব্যবসায় বিভাগে। অবশিষ্ঠ মানবিক বিভাগ । স্কুলে থাকাকালীন খুব কম শিক্ষার্থী ই থাকে যারা মানবিক বিভাগে পড়তে ইচ্ছুক থাকে । সাধারণত কলেজে ভর্তির সময় বিজ্ঞান কিংবা ব্যবসায় বিভাগের চাপ নিতে না পেরে শিক্ষার্থীরা পছন্দ হিসেবে বেছে নেয় মানবিক বিভাগ । আর কলেজ থেকেই একজন শিক্ষার্থী দেখতে শুরু করে দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার স্বপ্ন ।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীদের পছন্দের প্রথম সাড়িতে থাকে বুয়েট,মেডিকেল ও ঢাকা ইউনিভার্সিটি । সায়েন্সের শিক্ষার্থীদের ঢাকা ইউনিভার্সিটি ব্যাতিত আরো দুটি অপশন রয়ে যায়, মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং এর ।
তবুও সেক্ষেত্রে দেখা গেছে এবারের অর্থাৎ ২০১৮-১৯ সেশনের ঢাকা ইউনিভার্সিটির ক ইউনিটে (বিজ্ঞান বিভাগ) আবেদন করেছে ৮৮ হাজার ৯৫৫ জন এবং আসন সংখ্যা ১ হাজার ৭৫০ টি (সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক)। অর্থাৎ চান্স না পাওয়া শিক্ষার্থী থাকছে ৮৭ হাজার ২০০ জন ।
এবং বুয়েটে পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত হয়েছে ১২ হাজার ১৬১ জন এবং আসন সংখ্যাঃ ১ হাজার ৬০ টি (সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক)।
একি বিভাগের শিক্ষার্থীদের থেকে মেডিকেলে আবেদন করেছে ৬৯ হাজার ৪০৫ জন । যেখানে সরকারী এবং বেসরকারী মেডিকেল কলেজে মোট আসন ১০ হাজার ৪০৪ টি (সূত্রঃ প্রথম আলো) । যেখানে সরকারী মেডিকেলের আসন ৪ হাজার ৬৮ (সূত্রঃযুগান্তর)।
উক্ত আসন সংখ্যা এবং ভর্তী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা শিক্ষার্থীদের পরিমাণ যদি গণনা করা হয় তবে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর স্বপ্নে এখানেই ফাটল ধরে যায় এবং নেমে আসতে শুরু করে শিক্ষা জীবনে বিষন্নতা । দেখা গেল ডাক্তারী পড়ার ইচ্ছা থাকা কোন শিক্ষার্থী হয়ত মেডিকেলে উর্তীন্ন হয়েও গেল, কিন্তু তার অবস্থান হলনা ৪ হাজার ৬৮ জনের মধ্যে ।
“৭ হাজার সিরিয়ালে থাকা মেয়েটি তার বাবার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকায়,বাবাও তাকিয়ে থাকে মেয়ের দিকে । মেয়ে চোখ মুছে ফেলে বাবার সামনেই । বাবা চোখ মুছে পরিবারের আড়ালে । সিরিয়াল নম্বর ৭ হাজার,অর্থাৎ তাকে পড়তে হবে বেসরকারী মেডিকেলে। ছোট পরিসরে সরকারী চাকুরী করা এই পিতাও স্বপ্ন দেখে মেয়েকে ডাক্তার বানানোর । ৩০ হাজার টাকা বেতনের এই পিতা কি করে ডাক্তার বানাবে তার মেয়েকে । গুণতে হবে ৩০-৪০ লাখ টাকা ।”
একদিকে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন পূরণের সময়,অপরদিকে মদ্ধবিত্তের জীবন যুদ্ধ । কেমন আছে এই যুদ্ধে আহত হওয়া শিক্ষার্থীদের মন ? যুদ্ধে হয়ত বিধস্ত হয়ে গেছে শিক্ষার্থীর ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন । নতুন করে স্বপ্ন হয়ত বুণতে পারবে এই শিক্ষার্থী । কারণ ঢাবির “ক” ইউনিটে তার সিরিয়াল এসে পড়েছে ১০০০ এর ভেতর । নতুন করে হয়ত স্বপ্ন দেখা শুরু করতে পারল । কিন্তু যেই শিক্ষার্থী’র শেষ স্বপ্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,তার স্বপ্ন ভাঙলে নতুন স্বপ্ন মোড় নেবে কি ?
দেখা যাক কেমন আছে “খ” ও “গ” ইউনিটের শিক্ষার্থীরা,যাদের নেই মেডিকেল কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং হওয়ার কোন স্বপ্ন দেখার সুযোগ । টার্গেট একটাই । লোকমুখে যার নাম শোনা যায় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড তথা “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়” ।
২০১৮-১৯ সেশনে ঢাবির “খ” ইউনিটে আবেদন করেছে ৪২ হাজার ৯৫৪ জন এবং আসন সংখ্যা ৩৭৮ টি । উত্তীর্ণ হয়েছে ১০১৮৮ এবং অনুত্তীর্ণ ৩২০৬৬ জন । (সূত্রঃকালের কন্ঠ)
এবং, “গ” ইউনিটে আবেদন করে ২৯ হাজার ৫৮ এবং সিট সংখ্যা ১২৫০। যার মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছে ৪৩৬২ জন । (সূত্রঃ bdnews24.com)
শুধুমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ ইউনিটে আবেদনের সংখ্যাই ২ লাখ ৭২ হাজার ৫১২ জন । যেখানে আসন সংখ্যা মাত্র ৭ হাজার ১২৮ টি । (সূত্রঃ প্রথম আলো)
যেখানে শুধুমাত্র একটি বিশ্ববিদ্যালয়েই আবেদন হয় প্রায় আড়াই লাখের বেশি,সেখানে কতজন শিক্ষার্থীর স্বপ্ন লুকিয়ে থাকে তা হয়ত এক বাক্যে কখনো প্রকাশ হবেনা । শতশত শিক্ষার্থীর স্বপ্নের বাস্তবায়নে নামতে হয় ঢাল-তলোয়ার বিহীন এক যুদ্ধে । যার নাম হয় “ভর্তি যুদ্ধ”। এই যুদ্ধে জয়ীদের জন্য থাকে শুভ কামনা । কিন্তু পরাজিতদের জন্য ?
এই যুদ্ধের পরাজিত সৈনিকের সংখ্যা হিসাব করলে হয়ত দেখা যাবে জয়ীদের চাইতে অনেক অনেক বেশি । কিন্তু তারা তাদের স্বপ্নযুদ্ধে পরাজিত । আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এই পরাজিতদের প্রতি পদক্ষেপে যেন হিসাব মিলিয়ে মিলিয়ে চলতে হয় । পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স না পাওয়ায় অনেকে হয়ত নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নে ছুটে পড়ে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে । আবার অনেক শিক্ষার্থীর দেখা যায় ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সুযোগ হলেও, সুযোগ নেই নিজের ইচ্ছামত বিষয়ে পড়ার । পছন্দের সাবজেক্টে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার মত আর্থিক অবস্থাও থাকেনা অনেক শিক্ষার্থীর ।এক প্রকার বাধ্য হয়েই তাকে পড়তে হচ্ছে অপছন্দের বিষয়টি নিয়েই । স্বপ্নের মাঝা-মাঝি অবস্থানে পড়ে গেল এই শিক্ষার্থী ও । কিন্তু উপায় নেই । স্বপ্নযুদ্ধে আহত এই সৈনিক কেও বদলাতে হল স্বপ্নের মোড় ।
কিছু কিছু শিক্ষার্থীকে বাধ্য হয়েই পরিশেষে ভর্তি হতে হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভূক্ত কলেজে । বলা চলে এক প্রকার অনিচ্ছা নিয়েই ভর্তি হয় তারা ।
শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় কে কেন্দ্র করে “স্বপ্ন ও হতাশা” এই দুইটি বিষয়ের জন্ম নেয় হাজারো মেধাবী শিক্ষার্থীদের । আশানুরূপ ফলাফল না হওয়া যেই চরম হতাশার জন্ম নেয় তা হয়ত অনেকের জীবনেই কাল হয়ে দাঁড়ায় । যা বাঁধাগ্রস্ততা সৃষ্ঠী করে একজন শিক্ষার্থীর পরবর্তী ভবিষ্যত গঠনে ।
সফলতার অনেক গল্পই হয়ত আমরা পাঠ করে থাকি দৈনন্দিন,যাদের জীবন হয়ত কেটেছে আরো বেশি নির্মমতায়,দুর্ভাগ্যে অথবা হতাশা । শিক্ষা জীবনকে হতাশার কাছে সপে না দিয়ে যদি নতুন করে হতাশ হওয়ার করণ থেকে শিক্ষা লাভ করা যায়, তবে জীবন যুদ্ধে পরাজিত হওয়াকে শিক্ষা ভেবে এগিয়ে গেলে সফল হতে পারব আমরা সবাই। প্রসঙ্গক্রমে শিক্ষার্থীদের জন্য আমেরিকান লেখক ও শিল্পী “ফ্র্যাঙ্ক লয়েড” এর একটা উক্তি ব্যক্ত করেই ইতি টানা যায়ঃ
“সাফল্যের জন্য তোমাকে ৩টি মূল্য দিতে হবে: ভালোবাসা, কঠোর পরিশ্রম, আর স্বপ্নকে বাস্তব হতে দেখার জন্য ব্যর্থতার পরও কাজ করে যাওয়া।”
লেখকঃ মুবিন হাসান খান অয়ন