ঢাকাসোমবার , ৮ ডিসেম্বর ২০২৫
  1. সর্বশেষ

সুন্দরী গাছ বাঁচলে সুন্দরবন বাঁচবে

প্রতিবেদক
নিউজ ভিশন
৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১:২৭ অপরাহ্ণ

Link Copied!

শত প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে যে সুন্দরবন বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য ও উপকূলীয় অঞ্চলে পরিবেশের স্থিতিশীলতা নিশ্চিতে সদা প্রস্তুত থাকে। দেশের সেই দক্ষিণ-পশ্চিম বনভূমি এখন অনিরাপদ অবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মাঠ পর্যায়ে সুন্দরবনের ১০টি স্থান ঘুরে বনের জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ, ভূমির লবণ পরিস্থিতি, পরজীবী আক্রমণ, দূষণসহ কিছু সংকট খুঁজে পেয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের চার শিক্ষার্থী।

বাংলাদেশের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন খুলনা বিভাগ ও ভারতের উত্তর–দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা মিলিয়ে প্রায় ১০ হাজার বর্গ কিমি জুড়ে বিস্তৃত (বাংলাদেশে ৬ হাজার, ভারতে ৪ হাজার)। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য ও ১৯৯২ সালে রামসার সাইট হিসেবে স্বীকৃত এই বন পদ্মা–মেঘনা–যমুনার মোহনায় গড়ে ওঠা বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ইকোসিস্টেম। সুন্দরবন বাংলাদেশের পরিবেশগত ঢাল, জীববৈচিত্র্যের প্রধান ভরসা এবং উপকূলীয় মানুষের জীবন–জীবিকার অপরিহার্য সহায়ক।

সুন্দরবনে ১০০ ঘণ্টা:
সুন্দরবনে মাঠকর্মের প্রতিটি সকাল আমাদের শুরু হতো ভোরের আলো ফোটার আগেই। লঞ্চের ডেকে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখা ছিল দিনের প্রথম অনুভূতি। গাইডের বারবার স্মরণ করানো ‘লাইফ জ্যাকেট পরে নিন’ কিংবা ‘বাঘ আসতে পারে’ আমাদের মাঝে ভয়ের সাথে একটু হাসির রসও যোগ করত। সারাদিন মাঠে কাজ শেষে রাতে পোস্টার তৈরি করা, ক্লান্তি গায়ে থাকলেও নতুন কিছু শেখার আনন্দ সকল ক্লান্তিকে ছাপিয়ে যেত। এই সফর সুন্দরবনের বাস্তবতা যেমন দেখিয়েছে, তেমনি আমাদের গবেষণাকে দিয়েছে নতুন দিগন্ত।আমাদের জ্ঞানের এই নতুন দিগন্ত উন্মোচনে সার্বিক সহায়তায় সুপারভাইজর হিসেবে ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের প্রফেসর ড. অলক পাল স্যার এবং প্রফেসর ড. মাহবুব মুর্শেদ স্যার।

বনজ বাস্তুতন্ত্রের সংকেতবাহী বৃক্ষ সুন্দরী গাছ:
‘সুন্দরবনের হৃদয়ে দাঁড়িয়ে সুন্দরী গাছ, লবণ আর ঝড়ের বিরুদ্ধে নীরব প্রতিরোধ, পরজীবীর ক্ষতে ক্লান্ত হলেও হারায় না তার সবুজ প্রকৃতি। জোয়ারের জলে দোলে তারা, বনের প্রাণে রাখে জীবন-সঙ্গ, সুন্দরীর পতন মানেই বিপন্ন হয় পুরো সুন্দরবনের স্পন্দনরঙ্গ।’ হ্যাঁ, সত্যিই তাই। সুন্দরবনের বৃক্ষ গঠনে লবণাক্ত ও মাধ্যম-লবণাক্ত পরিবেশে টিকে থাকতে পারা সুন্দরী গাছ একসময় সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি ছিল। মাটির কার্বন সংরক্ষণে বড়ো ভূমিকা পালন, পাখি, হরিণসহ বহু প্রাণীর আবাসস্থল তৈরি, মাটি ধরে রাখা এবং উপকূলীয় ক্ষয় কমাতে সাহায্য করা সুন্দরী গাছের পরিমাণ ছিল ৬০-৭০%।

আন্ধারমানিক, শিবসা, পশুর আশেপাশের মিঠাপানির প্রভাবে থাকা সুন্দরী গাছগুলোর উচ্চতা ছিল ২৫-৩০ মিটার পর্যন্ত, বলিষ্ঠ ও ঘন কান্ডযুক্ত। তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় আমরা দেখেছি, অতিরিক্ত লবণাক্ততা বৃদ্ধি, টপ-ডাই ব্যাক (পরজীবী ও ফাংগাস) আক্রমণ, পুষ্টির ঘাটতি, জোয়ার ভাটার চক্রের পরিবর্তন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত স্ট্রেস ও মানবচাপের কারণে সুন্দরী গাছের উচ্চতা, ঘনত্ব,স্বাস্থ্য কমে যাচ্ছে এবং গাছের পরিমাণ হুমকির মধ্যে রয়েছে। আন্ধারমাণিকের মতো মিঠাপানির প্রভাবে থাকা এলাকায় সুন্দরীর ঘনত্ব এখনও তুলনামূলক বেশি। কিন্তু কচিখালি, কটকা, জয়মনি, হিরণ পয়েন্ট, করমজল, ডিমের চার, কোকিলমণির মতো উচ্চ লবণাক্ত এলাকায় সুন্দরীর পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কম বা পাতলা।

পর্যবেক্ষণে বনের ১০টি স্পটের দৃশ্য:

১. আন্ধার মানিক: লবণাক্ততা ও মিঠাপানির সংমিশ্রণে সুন্দরী গাছের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। মাটি: সিলটি-ক্লে।
২. কচিখালি: টাইগার ফার্ন, ছন, হেতাল গাছসহ অন্যান্য ম্যানগ্রোভ ও দেশজ গাছের আধিক্য রয়েছে। অভ্যন্তরের পুকুরগুলোতে রয়েছে মিঠাপানি যা বন্যপ্রাণীর পানির জোগানদাতা হিসেবে কাজ করে। মাটি- মিক্সড (সেন্ড+সিল্ট)
৩. কটকা জামতলা: দেশজ গাছের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। মাটি প্রায় ৬০% সেন্ডি।
৪. কটকা অফিস: কেওড়া গাছের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি (৭০%-হরিণের প্রধান খাবার)। মাটি- মিক্সড।
৫. ডিমের চর: নতুন সেডিমেন্টেশন বেশি হয়, মাটি সিল্ট।
৬. কোকিল মণি: সক্রিয় জোয়ার ভাটা, ক্লে মিক্সড সয়েল, মধ্যম লবণাক্ততায় গাছের স্বাস্থ্য মোটামুটি ভালো।
৭. হিরণ পয়েন্ট: বন্যপ্রাণীর মূল অঞ্চল, মাটি- সিল্ট।
৮. জয়মণি: বসতি ঘেরা এলাকা, সেলিনিটি বেশি হওয়ায় সুন্দরী গাছের পরিমাণ কম।
৯. দুবলার চর: সেন্ডি সয়েল ও উচ্চ লবণাক্ততা।
১০.করমজল: মৎস্য নির্ভর এলাকা। মাটি: সিল্ট।

দূষণের চিত্র:
বনের ১০টি স্পটে প্লাস্টিক বর্জ্যের পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ থার্মোকল পাওয়া গেছে। ধারণা করা হয় মাছ ধরার বরফবাক্স ভেঙে এসব থার্মোকল পানিতে মিশে মাইক্রোপ্লাস্টিক তৈরি করে, যা জলজ প্রাণী–উদ্ভিদের ক্ষতি, পানির স্বচ্ছতা হ্রাস এবং চারার বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করে। দুবলার চর (মৎস্য আহরণ ও ধর্মীয় বর্জ্য), কটকা অফিস–জামতলা (পর্যটন বর্জ্য), হিরণ পয়েন্ট (নৌযান বর্জ্য) ছিল দূষণের প্রধান উৎস।

বন্যপ্রাণী সংকট:
জায়গাগুলো পরিদর্শনে আমরা বন্যপ্রাণী খুব কমই দেখতে পেয়েছি। যেখানে সাধারণত হরিণ, বানর, জঙ্গলবিড়াল, বন্যশুকর, বিভিন্ন পাখি, সাপ ইত্যাদি দেখা যাওয়ার কথা, সেখানে বাস্তবে কাঁকড়া, কয়েকটা জায়গায় হরিণ ও করমজলে বানর ছাড়া আর তেমন কিছুর দেখা মিলছে না। এর সম্ভাব্য উল্লেখযোগ্য কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়- পর্যটনের শব্দদূষণ ও মানুষের চলাচলের প্রভাব, লবণাক্ততার পরিবর্তনে খাদ্যউদ্ভিদের পরিমাণ কমে যাওয়া, বনের গভীরে বণ্যপ্রাণীর সরে যাওয়া ইত্যাদি। এগুলো সুন্দরবনের বন্যপ্রাণীর বাস্তুসংস্থানের জন্য বড়ো সতর্ক সংকেত।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ক্ষয়ক্ষতি:

সুন্দরবন বাংলাদেশের উপকূলের প্রাকৃতিক সাইক্লোন-বাফার হলেও পরপর ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও ক্ষয়–ভাঙনে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সিডর (২০০৭) সুন্দরবনের প্রায় ৩০% এলাকা ধ্বংস করেছে ও বন্যপ্রাণীর আবাস ও মিঠাপানির স্তর ভেঙে দিয়েছে। আইলা (২০০৯) লবণাক্ততা ও ক্ষয়ক্ষতি আরও বাড়ায় এবং টপ-ডাইং রোগ বিস্তার লাভ করে। পরে রুয়ানু (২০১৬) ও আম্পান (২০২০)-এও উল্লেখযোগ্য ক্ষতি দেখা যায়।

সমাধানের উপায়ান্তর:
১. মিঠাপানির প্রবাহ বাড়ানো, অধিক লবণাক্ত সহনশীল বীজ উৎপাদন, পরজীবী নিয়ন্ত্রণে Bio-control technic ব্যবহার।
২. প্লাস্টিক-কর্কশিট দূষণ নিষিদ্ধকরণে জোরালো আইন প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন।
৩. গবেষণা নির্ভর আইন প্রণয়ন। যেমন: Sundori Disease Research Center স্থাপন, Salinity Mapping Laboratory স্থাপন ইত্যাদি।
৪. ভারত -বাংলাদেশ যৌথ সংরক্ষণ নীতি প্রণয়ন। (Joint River Commission +joint Tiger Conservation)
৫. বন্যপ্রাণীর উপস্থিতি কমে যাওয়া রোধে wildlife corridor Restoration, declare silent Zone, increase camera trap+drone survey ইত্যাদি পদক্ষেপ নিতে হবে।
৬. প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় Integrated Cyclone Buffer Zone তৈরি, Early warning, post Cyclone Quick Restoration team গঠন করতে হবে।
৭. Community based solution এ স্থানীয়দেরকে উৎসাহিত করা মনিটরিং করা ও বিভিন্ন কর্মসূচিতে যুক্ত করা।

আমাদের মাঠভিত্তিক পর্যবেক্ষণ থেকে ১০টি জায়গার যে চ্যালেঞ্জগুলো সামনে এসেছে, সেগুলো সুন্দরবনের নীরব বিপদের প্রতিচ্ছবি। তবে আশার কথা হলো– বৈজ্ঞানিক গবেষণা, কমিউনিটিভিত্তিক ব্যবস্থাপনা ও নীতিস্তরের সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে এই সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব। সুন্দরবন রক্ষায় উপরে নেওয়া পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি।

 

লেখক:
আফরিদা রিমা, সানজানা আমিন, মো. ইনতিছার শাহাদ রাফি, মাহির তাজোয়ার তকি— শিক্ষার্থী, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং ম্যানগ্রোভ ওটারস গ্রুপের সদস্য।

আরও পড়ুন

আনিসুল, আনোয়ারের নেতৃত্বে ২০ দলীয় গণতান্ত্রিক জোট

কক্সবাজারে সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ‘Businesses Development Training 2025’ অনুষ্ঠিত

এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষা : ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত সব কোচিং সেন্টার বন্ধ

শান্তিগঞ্জে মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটি গঠনে অসন্তোষ,ইউএনও বরাবর লিখিত অভিযোগ ‎

সাংস্কৃতিক শক্তিতে বদলে যেতে পারে কক্সবাজারের পর্যটন

শিক্ষাভবনের সামনে রাতেও অবস্থান করছেন শিক্ষার্থীরা

শিক্ষাভবনের সামনে রাতেও অবস্থান করছেন শিক্ষার্থীরা

তুরস্কের দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কুবির সমঝোতা স্মারক চুক্তি স্বাক্ষর

আমতলী ইসলামিয়া মাদ্রাসার গভর্ণিংবডির সভাপতি ড. মিজান ও বিদ্যুৎসাহী প্রতিনিধি মা: লুৎফর রহমান

দোয়ারাবাজার থানার ওসি জাহিদুল হকের শেষ কর্মদিবস— বিদায় জানালেন আবেগঘন বার্তায়

রংপুরে মুক্তিযোদ্ধা ও তার স্ত্রীকে জবাই করে হত্যা

ঢাকা কলেজের শিক্ষক এ.কে.এম রফিকুল আলমের বক্তব্য ভাইরাল ‘সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের দিয়েই কাউন্টার মব করতে হবে’

ঢাবি ভর্তিচ্ছুদের সহযোগিতায় চবিতে ছাত্রশিবিরের হেল্পডেক্স