শামসুল হুদা লিটনঃ
নিত্য প্রয়োজনীয়, রান্নায় ব্যবহৃত এবং ঔষধী গুনে সমৃদ্ধ পেঁয়াজের রয়েছে গৌরবময় অতীত ইতিহাস। পেঁয়াজ একটি অনন্য প্রাচীন মসলার নাম। নানা মজাদার রান্নায় ব্যবহার করা হয়। পেঁয়াজের রয়েছে অসংখ্য ঔষধি গুণ। পৃথিবীর প্রায় সব জনপদে রয়েছে পেঁয়াজের আলাদা কদর। আমাদের বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশে আদিকাল থেকেই পেঁয়াজের ব্যাপক ব্যবহার হয়ে আসছে।
বিভিন্ন তথ্য থেকে জানাযায়,
প্রাচীন রোমের বিখ্যাত খাদ্যরসিক ছিলেন এপিসিয়াস। এই এপিসিয়াসের লেখাতে সর্বপ্রথম পেঁয়াজের উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। প্রাচীন মিশরের বিখ্যাত পিরামিডের নির্মাণকাজে নিযুক্ত শ্রমিকদের রান্নাতেও ছিল পেঁয়াজ। পৃথিবীতে যখন কৃষি কাজের প্রচলন হয়নি সেই সময়েও খাদ্য হিসেবে পেঁয়াজের ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়।
মধ্য ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার প্রায় সাত সহস্রাব্দ আগের ব্রোঞ্জ যুগের কিছু মানববসতিতে সবজি হিসাবে পেঁয়াজের ব্যবহারের কিছু নমুনা পাওয়া গিয়েছে। আরেক দল গবেষকের মতে, ইরান ও পশ্চিম পাকিস্তানে সর্বপ্রথম পেঁয়াজের চাষ করা হয়। ইতিহাসবিদদের মতে, প্রাচীন ইতিহাসের গোড়ার দিকে চাষ হওয়া কিছু ফসলের মধ্যে পেঁয়াজ অন্যতম। প্রাচীন মানুষের কাছে পেঁয়াজ ছিল প্রয়োজনীয় একটি খাদ্য। প্রাচীন মানুষের তৃষ্ণাও মেটাতো পেঁয়াজ। যখন সব পুষ্টিকর খাদ্য ফুরিয়ে যেত সেসময় খাওয়ার জন্য আগে মানুষ পেঁয়াজ সংরক্ষণ করে রাখতেন।
প্রাচীন মিশরীয়দের কাছে পেঁয়াজ ছিল পূজনীয় বস্তু। তারা মনে করতো মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য পেঁয়াজ অতি গুরুত্বপূর্ণ। ফলে তাদের সমাধির মধ্যে তারা পেঁয়াজ রাখতো। এই ঘটনার সবচেয়ে চমকপ্রদ প্রমাণ পাওয়া যায় রাজা চতুর্থ রামেসিসের সমাধিতে। এই সমাধি আবিষ্কৃত হওয়ার পর দেখা যায় রাজা চতুর্থ রামেসিসের মমির দুই চক্ষু কোটরে ভরে রাখা হয়েছে পেঁয়াজ! এছাড়াও মৃতদেহের শরীরের নানা অংশে পেঁয়াজ রাখা হতো। বুকে পেঁয়াজের ফুল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হতো। মমির কান, পায়ের পাতা ইত্যাদি স্থানে পেঁয়াজ দিয়ে সাজানো হতো। বহু মিসরীয় পিরামিডের ভিতরের নানা চিত্রকর্মে পেঁয়াজের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।
কিছু মিশরীয়দের ধারণা ছিল পেঁয়াজের ঝাঁঝালো গন্ধ ও তার জাদুকরী ক্ষমতায় মৃত মানুষ আবার নিঃশ্বাস নেওয়া শুরু করে। গবেষকদের মতে, এমন ধারণার পিছনে কারণ হলো, পেঁয়াজের ঔষধি গুণ। পেঁয়াজের ঔষধি গুণের কারণে নানা অসুখ ভালো হতো। ফলে মিশরীয়রা পেঁয়াজকে জাদুকরী বস্তু মনে করতো।
তবে প্রাচীন মিশরীয়দের তুলনায় প্রাচীন গ্রিকরা পেঁয়াজের ব্যবহারে ছিল কয়েক ধাপ এগিয়ে। তারা পেঁয়াজের বহু স্বাস্থ্যগত উপকারিতা সম্পর্কে অবগত ছিল। ফলে প্রাচীন গ্রিসের ক্রীড়াবিদরা প্রচুর পরিমাণে পেঁয়াজ খেতো। এছাড়াও নিজেদের পেশী আরো মজবুত ও শক্তিশালী করতে রোমান গ্লাডিয়েটররা তাদের শরীরে পেঁয়াজ মালিশ করতো। রোমানরাও পেঁয়াজের নানা উপকারী দিক সম্পর্কে জানতো। তারা দাঁতের ব্যথা কিংবা অনিদ্রা দূর করতে পেঁয়াজ খেতো। প্রাচীন রোমে যে ব্যাপক আকারে পেঁয়াজের চাষ হতো তার প্রমাণ পাওয়া যায় অগ্নুৎপাতে চাপা পড়ে যাওয়া পম্পেই নগরীতে। সেখানেও প্রত্নতত্ত্ববিদরা খুঁজে পেয়েছেন পেঁয়াজ চাষের প্রমাণ। বাইবেলেও ইসরাইলীদের পেঁয়াজ খাওয়ার উল্লেখ পাওয়া যায়।
মধ্যযুগে পেঁয়াজকে দেখা হতো ‘সুপার-ফুড’ হিসাবে। সেসময় মানুষ ঠিক মুদ্রার মতো পেঁয়াজ ব্যবহার করতো। নানা কাজের পারিশ্রমিক হিসাবে কিংবা ভাড়া পরিশোধ করার ক্ষেত্রেও পেঁয়াজের প্রচলন ছিল। এছাড়াও বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান যেমন বিয়েতে মানুষ বর-কনেকে পেঁয়াজ উপহার দিতো। মধ্যযুগে ইউরোপীয় রান্নার প্রধান তিন উপাদান ছিল শিম, পেঁয়াজ ও বাঁধাকপি। ধনী গরীব নির্বিশেষে সবাই খাবারে পেঁয়াজ ব্যবহার করতো।