আবহাওয়ার ন্যায় জলবায়ুর উপাদানসমূহ নিয়ন্ত্রিত হয় বিভিন্ন নিয়ামক দ্বারা যেমনঃ- অক্ষাংশ, ভূপৃষ্ঠের উচ্চতা, বায়ুপ্রবাহের দিক, সমুদ্রস্রোত, বনভূমি, মাটির বিশেষত্ব ইত্যাদি। জলবায়ুর বিভিন্নতার দরুণ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে, মানুষের অর্থনৈতিক কার্যাবলি ও সাংস্কৃতিক জীবনের মধ্যেও পার্থক্য দেখা যায়। প্রাকৃতিকভাবে পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তিত হয়ে আসছে-তাই এটিকে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াও বলা হয়। বর্তমানকালে, সামাজিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোন থেকে জলবায়ু পরিবর্তন বললে সারা পৃথিবীর ইদানিং সময়ের মানবিক কার্যক্রমের কারণে সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনকে বোঝায়। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, শক্তি উৎপাদন, পন্য উৎপাদন, বন উজার ইত্যাদি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণসমূহ বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উপনীত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন মানব জীবনের সার্বিকক্ষেত্রে স্থায়ী বা অস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের কৃষি, বনভূমি, খনিজ সম্পদ, মৎস্য ক্ষেত্র, যোগাযোগ ব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়গুলোতে বিশদভাবে প্রভাব ফেলে। এতে বাংলাদেশ ঝুঁকিতে থাকে এবং তা মোকাবেলার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে।
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে জলবায়ুর পরিবর্তনের ঝুঁকি ও সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে ইতোমধ্যে বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। জানুয়ারি ২০০৯ এ প্রকাশিত ‘Climate of Disaster” এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-“পরিবেশের বিপর্যয়ের ফলে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে যেসব বড় ধরণের প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে তা মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই হচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিই মূলত এ পরিবর্তিত জলবায়ুর জন্য দায়ী। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের ঝুঁকি ও সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতিসমূহ আলোচনা করা হলো-
সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিঃ বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ব-দ্বীপ, যেখানে অসংখ্য নদনদী বয়ে
চলেছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা ১° সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশের ১১ শতাংশ ভূমি সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। বাংলাদেশের সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতিবছর ৭ মিলিমিটার হারে বাড়ছে। IPCC (Intergovernmental Panel on Climate Change) এর সমীক্ষা অনুযায়ী, বর্তমানে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি দশকে ৩.৫ মিলিমিটার থেকে ১৫ মিলিমিটার বৃদ্ধি পেতে পারে। এমনকি ২১০০ সাল নাগাদ তা ৩০ সেমি থেকে ১০০ সেমি এ পৌঁছাতে পারে। সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।
মরূকরণঃ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে ভূপৃষ্ঠে জলের পরিমাণ ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। মরুভূমির বৈশিষ্ট্য দেখা দিচ্ছে।
নিম্নভূমিতে প্লাবনঃ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অন্যান্য নিম্নভূমি সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। এছাড়াও উপকূলীয় এলাকাসমূহ ক্রমেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
জীববৈচিত্র্য ধ্বংসঃ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। পরিবেশ ও ভূ-বিজ্ঞানীদের মতে, সমুদ্রের উচ্চতা মাত্র ১ মিটার বৃদ্ধি পেলে সুন্দরবনের ৭০ ভাগ তলিয়ে যাবে। বনাঞ্চলসমূহের ধ্বংসের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য কমে বাস্তুসংস্থান বিপর্যয়ের আশংকা দেখা দিচ্ছে।
জলের লবণাক্ততা বৃদ্ধিঃ বর্তমানে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে দূরবর্তী দ্বীপসমূহের প্রায় ১.৪ মিলিয়ন হেক্টর এলাকায় লোনা জল প্রবেশ করায় উন্মুক্ত জলাশয় ও ভূগর্ভস্থ জল লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তিত হওয়ার সাথে সাথে এই লবণাক্ততার মাত্রা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
নদ-নদীর প্রবাহ হ্রাসঃ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নদ-নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘ্নিত হয়। নদীর ক্ষীণ প্রবাহের কারণে সামুদ্রিক লোনা জল সহজে অভ্যন্তরীণ নদীপ্রবাহে প্রবেশ করে নদ-নদীর জলেতে লবণাক্ততা বাড়িয়ে দেবে।
বিপন্ন কৃষিঃ জলবায়ুর পরিবর্তন বাংলাদেশের কৃষিখাত ও দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এছাড়াও, প্রয়োজনীয় সেচের অভাবে দেশের উত্তর-পশ্চিমে চাষাবাদ ব্যাপকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, উচ্চ কার্বন নিঃস্কাশন, বন্যা ও বন্ধনী দিকে বৃদ্ধি, সমৃদ্ধির প্রতি আত্মঘাতী প্রভাব, ওজনে বৃদ্ধির ফলে সীমান্ত এলাকার জনসংখ্যা প্রবল প্রভাবিত হচ্ছে। বিশ্ব ও বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ ও প্রভাব সম্পর্কে চিন্তা করতে হবে এবং বাংলাদেশের ঝুঁকি ও সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাব্য সমাধানের জন্য সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার ফলপ্রসূ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ এবং সচেতন করার পাশাপাশি বিশ্ব পরিমন্ডলের শীর্ষ নেতৃত্বদানকারীদের এগিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
লেখক
সুমন দাস,
সাবেক শিক্ষার্থী,
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ,
গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।