সাদিয়া আফরিন,ইডেন মহিলা কলেজ
বর্তমানে শিশু, কিশোরদের খাদ্যের পছন্দের তালিকার শীর্ষে রয়েছে বিভিন্ন ধরণের মুখরোচক খাবার। যাকে আমরা ফাস্টফুড বলে থাকি। অনেকে সময় বাঁচাতে কিংবা স্বল্পমূল্যের মুখোরোচক খাবারের দিকে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। কিন্তু ফাস্টফুডের তৈরীর উপাদান শরীরের কী কী ধরণের পরিবর্তন দেখা যায়, সেসব দিক বিবেচনা না করেই আমরা মুখরোচক খাবারের দিকে আকৃষ্ট হই। কর্মব্যস্ততা, শিশুদের অতিরিক্ত চাহিদা, ডিপ্রেশনে অতিরিক্ত তেল চর্বি যুক্ত খাবারের দিকে আকৃষ্ট হয়। যার ফলস্বরূপ দেখা দেয় অতিরিক্ত ওজন, কিডনি, লিভারের সমস্যা। ধীরে ধীরে রূপ নেয় অকালমৃত্যু।
ফাস্টফুড বলতে বার্গার, পিজ্জা, ফ্রাইড রাইস, চিকেন, চিপস, নুডলস, পাস্তা, সসেস,কোমল পানীয় ইত্যাদীকে বুঝানো হয়। স্বল্প সময়ে বাহারি ফাস্টফুড মনকে সহজেই আকৃষ্ট করে দেয়। দ্রুত খাবারের সুবিধা এবং স্বল্পমূল্যের কারণে কর্মব্যস্ত মানুষ, শিশু কিশোররা বেশি ঝুঁকছে। তবে ফাস্টফুডের মধ্যেই লুকিয়ে আছে মরণফাঁদ। ফাস্টফুডে কোনো পুষ্টিগুণ নেই বললেই চলে। উচ্চমাত্রায় ট্রান্সফ্যাট, অতিরিক্ত পরিমাণে চিনি, অ্যালকোহলীয় কোমল পানীয়, ক্যামিকেল সমৃদ্ধ সস দিয়ে ড্রেসিং বা কোডিং করা হয়ে থাকে। ট্রান্সফ্যাট রক্তের খারাপ কোলেস্টেরল (LDL)বাড়ায়, ভালো কোলেস্টেরল(HDL) কমায়। ধমনীর মধ্যে চর্বি জমে রক্তপ্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে। হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। আমাদের দেশে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কিশোর কিশোরীদের মৃত্যু বেশী হয়, এছাড়া ও অতিরিক্ত চিনি ও কার্বোহাইড্রেট রক্তের গ্লুকোজের পরিমাণ বাড়ায় ফলে অগ্নাশয়কে বেশী পরিমাণের ইনসুলিন রেজিস্টেন্স করতে হয় যা পরবর্তীতে টাইপ -২ ডায়াবেটিস দেখা দেয়। এছাড়া ও গ্রামের তুলনায় শহরের মানুষের মধ্যে ডায়াবেটিস বেশী দেখা যায় এর প্রধান কারণ হলো অনিয়ন্ত্রিত জীবন -যাপন ও ফাস্টফুডের আসক্তি। তাছাড়া ফাস্টফুডে দেহের প্রয়োজনীয় উপাদান ভিটামিন, মিনারেল নাই বললেই চলে ফলে বিভিন্ন ভিটামিনের ঘাটতিতে বিভিন্ন রোগ দেখা যায়। ফাস্টফুড ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার হওয়ায় স্থুলতা দেখা যায়। স্থুলতা এখন শুধু অলসদের রোগ নয় নারী, পুরুষের এমনকি শিশুদের ও দেখা যায়। ফাস্টফুড জাতীয় খাবার সিজিনিংয়ে ব্যবহার করা হয় মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট যা ক্যান্সার, টিউমার, নিউরোলজিক্যাল ডিসঅর্ডার এর জন্য দায়ী। ফাস্টফুডে অতিরিক্ত ক্ষতিকর উপাদান থাকায় ত্বকে ব্রণ, অল্প বয়সেই ভাঁজ পড়ে। ফাস্টফুডে আয়রন না থাকায় আয়রনের অভাবে বুদ্ধি বিকাশে সমস্যা সৃষ্টি হয়। ফাস্টফুডে প্রচুর পরিমাণের শর্করা থাকে যা পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটায়। এছাড়া ও অতিরিক্ত লবন আমাদের হার্টের জন্য ক্ষতিকর। ফাস্টফুডে লবনের পাশাপাশি স্বাদ বৃদ্ধির জন্য টেস্টিং সল্ট ব্যবহার করা হয়। যা আমাদের চিন্তাশক্তিকে দুর্বল করে দেয়। এবং আমাদের হার্ট ধীরে ধীরে অকেজো করে দেয়। অনেক খাবারে প্রিজারভেটিভ ও আর্টিফিশিয়াল ফ্লেভার দেওয়া থাকে যা মস্তিষ্কের নতুন নিউরন তৈরীতে বাঁধা দেয় এবং নার্ভ দুর্বল করে দেয়।
নব্বইয়ের দশকে ফাস্টফুডের রেস্টুরেন্ট ছিলো হাতেগোনা। কালক্রমে তা বিস্তৃত হতে হতে অলিতে গলিতে ভরপুর। বাহারী রান্না, সুগন্ধে মানুষ আকৃষ্ট হয় ফাস্টফুডের দিকে। এখন তা শিশুদের মাঝে ও ছড়িয়ে পড়েছে। শিশুরা এখন সুষম খাদ্য খেতে চায়না। শিশুদের বায়নাতে বাবা মায়েরা ও অজান্তে তার হাতে তুলে দেন ফাস্টফুড। যুক্তরাষ্ট্রের একগবেষণায় বলেছে, ফাস্টফুডে মাএ ৩% পুষ্টি উপাদান থাকে। যা আমাদের দেহের পুষ্টির চাহিদার তুলনায় অনেক কম। চেইঞ্জিং ডায়াবেটিক অফ চিলড্রেন ( সিডিআইসি) এর পরিচালক ড• বেদুরা বলেন শিশুদের স্বাদগ্রন্থি এমন যে চর্বি চিনি লবনযুক্ত খাবার তাদের বেশী আকৃষ্ট করে, ফাস্টফুডের কিছু কিছু উপাদান ব্রেইনে আসক্তির সৃষ্টি করে। যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইয়ো স্ট্রেট বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় দেখা গিয়েছে যেসব শিশুরা ফাস্টফুডে আসক্ত তাদের বুদ্ধি বিকাশ কম, অংক, বিজ্ঞান ও মুখস্থে দুর্বল। অনেক সময় ফাস্টফুড হজমে সমস্যা সৃষ্টি করে। নিয়মিত ফাস্টফুড শরীরে দীর্ঘমেয়াদি রোগ সৃষ্টি করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের পরামর্শপএের একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের দৈনিক ৩০ গ্রামের কম এবং নারীদের ২০ গ্রামের কম স্যচুরেটেড ফ্যাট গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। ট্রান্সফ্যাটের ক্ষেএে ৫ গ্রামের চেয়ে কম। তবে একটা বার্গারেই স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে ১০ গ্রামের মতো। শুধু বার্গারেই সীমাবদ্ধ নয় সাথে থাকে কোমল পানীয় যা টাইপ ২ ডায়াবেটিসের দিকে ধাবিত করে।
ফাস্টফুড শুধু স্বাস্থ্য নয় সামাজিক আচরণে ও প্রভাব ফেলছে। পরিবারের সাথে একসাথে খাবার খাওয়ার প্রবণতা কমে যাচ্ছে। ঘরোয়া পরিবেশে খাবারের প্রতি অনীহা সৃষ্টি করছে। যা আমাদের খাদ্যসংস্কৃতির উপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে।
ফাস্টফুড থেকে আমাদের প্রত্যেকের বেরিয়ে আসা জরুরি। একেবারে ফাস্টফুড বন্ধ করা সম্ভব না, সেদিক বিবেচনায় যে যার যার জায়গা থেকে আমাদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। কারণ সচেতনায় ই পরবর্তী সুস্থ প্রজন্মের জন্ম দিবে। আমাদের ঘরোয়া পরিবেশে রান্নার অভ্যাস ফিরিয়ে আনতে হবে। আমাদের সুষম খাদ্য, ভিটামিন, মিনারেল সমৃদ্ধ শাকসবজি খেতে হবে। পাশাপাশি শিশুদের ও অভ্যস্ত করাতে হবে। ধীরে ধীরে ফাস্টফুড খাওয়ার অভ্যাস কমিয়ে আনতে হবে। সপ্তাহে ৩দিন ফাস্টফুড খেলে তা কমিয়ে একবেলায় আনতে হবে। শুধু স্বাদ না পুষ্টিগুণের দিকে খেয়াল রেখে খাদ্যগ্রহণ করতে হবে। ঘুম কম হলে ফাস্টফুডের প্রতি আকর্ষণ বাড়ে তাই পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমানোর দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
সর্বোপরি ফাস্টফুডের দিকে না ঝুঁকতে আমাদের স্লোগান হবে,
“ফাস্টফুড নয়, সুষম খাই
অসুস্থ নয়, সুস্থ থেকে যাই।”