নিঙোল অর্থ বোন, আর চাকৌবা-র অর্থ মধাহ্ন ভোজের নিমন্ত্রন। ‘নিঙোল চাকৌবা’, যার অর্থ পিতৃগৃহে বিবাহিতা কন্যা ও ভগ্নীদের বড় ভোজ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ। মীতৈ মণিপুরীদের বিবাহিত ও অবিবাহিত বোন দের একত্রে নিমন্ত্রন করে একসাথে মধাহ্ন ভোজের আয়োজন এবং তার সঙ্গে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও তারপর সবার হাতে উপহার সামগ্রী তুলে দিয়ে এবারও আবেগঘন অনুষ্ঠান হিসেবে পালন করা হয়৷
‘নিঙোল চাকৌবা’ উৎসবের ইতিহাস :
মণিপুরীদের ইতিহাস অনুযায়ী ৩৩ খ্রিষ্টাব্দে রাজা নোংদা লাইরেল পাখংবা সময় থেকে ভারতের মণিপুরে এই উৎসব উদযাপন করে আসছে। যখন রাজা নোংদা লাইরেল পাখংবা মণিপুরে রাজত্ব করতেন। রানী লাইসানা তার ভাই পোয়ারইটনকে বছরে একবার ভোজের জন্য রাজার প্রাসাদে আমন্ত্রণ জানাতেন। তাই, এটি নিঙোল চাকৌবা’র পরিবর্তে পিবা (ভাই/ছেলে) চাকৌবা নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু উনিশ শতকে রাজা চন্দ্রকীর্তি সিংহের (নিংথেম পিশক) তার সময়ে এই ঐতিহ্যের পরিবর্তন হয়। তিনি তার বোনদের ভোজের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন কারণ একদিনে তাদের জায়গায় যাওয়া তার পক্ষে কঠিন ছিল। এইভাবে, ঐতিহ্যটি তখন থেকে নিঙোল চাকৌবা’র পরিবর্তিত হয় এবং মণিপুরের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে।
নিঙোল চাকৌবা বনাম ভাই ফোঁটা উৎসবের পার্থক্য
বাঙ্গালী ও অনান্য হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ভাইদের সম্মানার্থে ও মঙ্গল কামনায় যেভাবে ভাই ফোঁটা দেওয়া হয় ঠিক এই একই ভাবে মীতৈ মণিপুরী সম্প্রদায়ের প্রত্যেকের বাড়িতে ভাইয়েরা বোনদের সম্মানার্থে ও মঙ্গল কামনায় বোনদের জন্য মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজন নাম নিঙোল চাকৌবা। এখন আমরা জানতে চাইবো নিঙোল চাকৌবা বনাম ভাই ফোঁটা উৎসবের পার্থক্য।
ভাইফোঁটা হিন্দুদের একটি উৎসব। এই উৎসবের পোষাকি নাম ভ্রাতৃদ্বিতীয়া অনুষ্ঠান। কার্তিক মাসের শুক্লাদ্বিতীয়া তিথিতে (কালীপূজার দুই দিন পরে) এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। বাঙালি হিন্দু পঞ্জিকা অনুযায়ী, এই উৎসব কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের ২য় দিনে উদযাপিত হয়। মাঝেমধ্যে এটি শুক্লপক্ষের ১ম দিনেও উদযাপিত হয়ে থাকে। কথিত আছে, এই দিন মৃত্যুর দেবতা যম তার বোন যমুনার হাতে ফোঁটা নিয়েছিলেন। অন্য মতে, নরকাসুর নামে এক দৈত্যকে বধ করার পর যখন কৃষ্ণ তার বোন সুভদ্রার কাছে আসেন, তখন সুভদ্রা তার কপালে ফোঁটা দিয়ে তাকে মিষ্টি খেতে দেন। সেই থেকে ভাইফোঁটা উৎসবের প্রচলন হয়।
নিঙোল চাকৌবা হলো মীতৈ মণিপুরীদের জনপ্রিয় সামাজিক উৎসব উদযাপিত উৎসবগুলোর মধ্যে অন্যতম যা মণিপুরি ক্যালেন্ডারের ‘হিয়াংগেই’ মাসের নতুন চাঁদের দ্বিতীয় দিনে কার্তিক মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয় তিথিতে এই উৎসবটি পালিত হয়। নিঙোল মানে ‘বিবাহিত মহিলা’ এবং চাকৌবা মানে ‘ভোজের আমন্ত্রণ’; তাই উৎসব হল এমন একটি যেখানে বিবাহিত মহিলাদের তাদের পিতামাতার বাড়িতে ভোজের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। নিঙোল চাকৌবা কয়েকদিন পূর্বে বিবাহিতা কন্যা ও ভগ্নীদের প্রথাগতভাবে ‘পানা’ (পান ও সুপারি দিয়ে আমন্ত্রণ) পাঠিয়ে আমন্ত্রণ জানান হয়। বৃদ্ধা বা মুরব্বীদের জন্য এ দিনটি হলো কিছুক্ষণের জন্য হলেও তাদের পূর্ববর্তী গৃহ, যেখানে তাদের শিকল ছিল সেখানে ফিরে যাওয়া এবং পারিবারিক বন্ধনের একাত্মতা প্রকাশ করার সুযোগ ও ব্যবস্থা। পিতৃগৃহে মহিলারা মহার্ঘ খাবার, উপহার ও আমোদ-প্রমোদে আপ্যায়িত হয়। মহাভোজের পর পিতামাতা ও ভাইয়েরা তাদের কন্যা ও বোনদের উপহার প্রদান করে থাকেন। পরিবর্তে তারা ভাইদের এবং পিতা-মাতার উদ্দেশ্যে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে থাকে।
মণিপুরি মুসলিমরা উদযাপন করেন কিনা?
মণিপুরীদের মধ্যে একটি মুসলিম জাতি আছে তারা হলো পাঙাল বা মণিপুরি মুসলিম। এই সম্প্রদায়ের মানুষরা নিঙোল চাকৌবা উদ্যাপন অনুষ্ঠানে উল্লেখযোগ্য সূত্র পাওয়া যায়নি, তবে সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভারতের মণিপুর রাজ্যে মীতৈ মণিপুরিদের সামাজিক উৎসবে ছবি বা আমন্ত্রনের অংশগ্রহণ বা শুভেচ্ছা বিনিময়ে দৃশ্য লক্ষ্য করা যায়৷ সুতরাং মণিপুরি মুসলিমদের সামাজিক চিত্রে চাকৌবা শব্দের সাথে সংস্কৃতি পাওয়া যায়৷ হঠাৎ পারিবারিকভাবে যেকোনো সময আত্মীয় স্বজনের দামান (বর) বা কন্যার কাউকে ভাত খাওয়ার দাওয়াত দেওয়া হলো হলো চাকৌবা৷
আর নিঙোল অর্থ বোন৷ নিঙোন চাকৌবা নাম বিশেষ একদিন ভাইয়েরা বোন গুলোকে দাওয়াত দেওয়ার বিশেষ দিন ইসলামে নেই৷ নিঙোল চাকৌবা নিয়ে কোন ইসলামিক চিন্তাবিদদের মাসয়ালা আছে কিনা জানা নাই৷ নিঙোল চাকৌবাকে উৎসব বানিয়ে নাচ গান ইত্যাদি করাতো জায়েজ না। তবে এটি যেকোন দিন ভাইয়েরা তার বোনকে দাওয়াত দেওয়া জায়েজ আছে৷ ইসলামে আত্মীয় স্বজনের ভালো সম্পর্ক রাখার ব্যাপারে উল্লেখ রয়েছে। এবং ভাই-বোনের হক বা অধিকারের প্রতিও ইসলাম যথেষ্ট গুরুত্ব প্রদান করেছে। হাদিসে বড় ভাইকে বাবার সমান এবং বড় বোনকে মায়ের সমান বলা হয়েছে। সুতরাং একজন সন্তানের ওপর মাতা-পিতার যেসব হক বা অধিকার রয়েছে, বড় ভাই ও বড় বোনের ব্যাপারেও ছোট ভাই এবং ছোট বোনদের একই হক বা অধিকার।
মণিপুরের বাইরে এই উৎসব উদযাপন :
পারিবারিক শান্তি এবং সামাজিক স্থিরতা দৃঢ় করার গোষ্ঠীবদ্ধ প্রয়াসে সামাজিক একতা অনুপম আয়োজনে পরিবার ছাড়াও সামাজিক সংগঠন ‘নিঙোল চাকৌবা’ উৎসবের আয়োজন করে থাকে। এই উৎসব মনিপুরী জাতির মূলভূমি মণিপুর রাজ্যের বিভিন্ন স্থানের সামাজিক সংগঠনগুলো যেমন আয়োজন করে থাকে, ঠিক তেমনি মণিপুরের বাইরে বাংলাদেশ, মিয়ানমার, ত্রিপুরা ও আসামেও মনিপুরী অধ্যুষিত এলাকাতে পারিবারিকভাবে এবং সামাজিক সংগঠনগুলোর মাধ্যমে এই উৎসব আয়োজন করে।
প্রতিবছরের মতো এবারের গতকাল কমলগঞ্জের মণিপুরী কালচারাল কমপ্লেক্স প্রাঙ্গণে নানা আয়োজনে ‘নিঙোল চাকৌবা’ উৎসবের বাংলাদেশের মণিপুরী অধ্যুষিত বিভিন্ন অঞ্চলের প্রায় দু শ ‘নিঙোল’ বা বোনদের আমন্ত্রণ জানিয়ে প্রায় দু শ ‘পিবা’ বা ভাইদের উপস্থিতিতে ভূরিভোজ ও উপহারসামগ্রী প্রদানের আয়োজন করা হয়।
নিউজ ভিশন, সহ সম্পাদক