——মোহাম্মদ আবদুল্লহ মজুমদার :
ফটোগ্রাফিকে পেশা হিসেবে বেছে নেবেন এমন কোন পরিকল্পনা ছিল না। তবুও ভাগ্য তাকে বিশ্বনন্দিত আলোকচিত্রীর আসনে নিয়ে গেছেন। না! আমি কোন ভাগ্য নির্ধারনকারী কিংবা জৌতিষী নই। তার জীবনের গল্প শুনেই ভাগ্যকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হচ্ছি। বাবা-মা চেয়েছিলেন ছেলে প্রকৌশলী হবে, নিজের ইচ্ছে ছিল পাইলট হওয়ার।
তার বাবাও ছবি তুলতেন। কিন্তু বাবার ছবি তোলার সখ একদিন ছেলের মধ্যে সংক্রমিত হলো।
ছবি তুলতে তুলতে একদিন পারিবারিক ফটোগ্রাফার থেকে হয়ে গেলেন আন্তর্জাতিক ফটো সাংবাদিক। তাঁর আলোকচিত্রগুলোতে শুধু একটি ছবি দেখা যায় না। এর ভেতরে আছে অন্যরকম অনুধাবন মূলক আলো।
কমিউনিষ্ট পার্টির পত্রিকা একতা দিয়ে শুরু করেছিলেন, দীর্ঘ কয়েক দশক কাজ করেছেন মার্কিন বার্তা সংস্থা এসোসিয়েটেড প্রেসের সঙ্গে।
বাংলাদেশের বহু ঘটনা-দুর্ঘটনা-দুর্যোগের সাক্ষী এ কিংবদন্তি ক্যামরার সঙ্গী। উপকূলের ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়া মানুষ, ঢাকার রাজপথের মিছিল কিংবা রাষ্ট্রনায়কের মুখ, তাঁর ক্যামেরায় ধরাপড়া অনেক স্থিরচিত্রই এখন ইতিহাসের অংশ।
বুকে-পিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ শ্লোগান লিখে এরশাদ বিরোধী গণআন্দোলনে ঢাকার রাস্তায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন নুর হোসেন, মৃত্যুর পূর্ব-মূহুর্তে পাভেল রহমানের ক্যামেরায় ধরা পড়া তার সেই ছবিটিই হয়ে উঠেছিল এই আন্দোলনের প্রতীক। আর সে ছবিই তথাকথিত স্বৈরাচারকে পিছু হটতে বাধ্য করেছিলো। হ্যাঁ, আমি বিশ্বনন্দিত বাংলাদেশি আলোকচিত্রী পাভেল রহমানের কথা বলছি।
সেদিন (৭ নম্বেবর ২০১৯) ক্লাসের দীর্ঘ আলাপচারিতায় পাভেল রহমান তার দীর্ঘ জীবনের নানা বর্ণালি ঘটনার স্মৃতচারণ করেছেন। শিক্ষক হিসেবে তাকে পাবার সুযোগ অলঙ্কিত করেছিলো জীবনের কয়েকটি লগ্নকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন বহু অতিথি শিক্ষক ক্লাস নিয়ে থাকেন। কিন্তু সেদিন পাভেল রহমানকে স্থায়ী শিক্ষক হিসেবেই পেতে ইচ্ছে করছিলো। শুধু তার জীবনের গল্প শুনবার জন্য। সেদিন আমি তাকেই বলেছি, যে আমাদের স্মৃতিশক্তির চেয়েও তার কৃতিত্বের পথ অনেক দীর্ঘ। জীবনের ৬ বারেরও বেশিবার মৃত্যুর মুখ থেকে আল্লাহ তাকে হয়ত ফিরিয়ে এনেছেন আমাদের এ মহান আলোকচিত্রীর জীবনের গল্প শুনাবার জন্যই।
জীবনে তিনি সিনিয়রদের কাছ থেকেও অবহেলার শিকার হয়েছেন। আমার জীবনেও আছে তেমন কতগুলো গল্পের সমাহার। কিন্তু কারো অবহেলা ও গালমন্দ তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। আপন দূরদর্শিতা তাকে পৌঁছে দিয়েছে কৃতিত্বের অনন্য উচ্চতায়। যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক কৃতিত্ব অর্জন থেকে তাকে ফেরাবার চেষ্টা করা হয়েছিলো সেখানে তার বৈশ্বিক স্বীকৃতি দেখে নিন্দুকরা চরম লজ্জায় পড়েছিলো।
তার স্বীকৃতি ও পুরস্কারের কথা বলে এখানকার লেখার দীর্ঘ বাড়িয়ে পাঠকের বিরক্তি বাড়াতে চাই না। তিনিও এসব পুরস্কারকে তার জীবনের কাঙ্খিত পাওয়া বলে মনে করেন না। তার ছবির মাধ্যমে মানুষের জীবনে যেসব প্রভাব পড়েছে সেসবকেই তিনি জীবনের চাওয়ার চেয়েও অধিক পাওয়া হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত আলোকচিত্রী হবার আমন্ত্রনে তিনি ততোটা উল্লাসিত হননি। যতোটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন শহর নগর ঘুরে ঘুরে মানুষের জীবনের গল্প তুলে আনার জন্য।
আধুনিক যন্ত্রপাতি, কপি-পেস্ট ও ফটোশপের যুগেও তার মতো কৃর্তিমান হবার জন্য সততাকেই একমাত্র পুঁজি হিসেবে উল্লেখ করেছেন তিনি। শুধু কি দৃষ্টিনন্দন ছবি? তার প্রত্যেকটি ছবির পেছনে আছে মানুষের জীবনের সংগ্রাম, বেঁচে থাকার লড়াই ও সুখ-দুঃখের হৃদয়স্পর্শী গল্প। গল্পগুলো যেন বিরামহীনভাবে তার ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য করে।
ডিপার্টমেন্টে সপ্তাহে চারদিন আমরা দুঘণ্টা করে ক্লাস করি। প্রতিদিন মনেহয় এ দুঘণ্টায় যেন আমাদের বোঝি দুদিন চলে গেল। কিন্তু এ নন্দিত আলোকচিত্রীর জীবনের টানে সেদিন আমাদের ক্লাস ছাড়তে ইচ্ছে করছিলো না। ইচ্ছে করছিলো অবিবারম শুনতে থাকি এমন সংগ্রামমাখা সফলতার গল্প।
৬৫ বছর বয়সী এ আলোকচিত্রী বলেন, আমি আরো অনেক দিন বাঁচতে চাই। সংগ্রাম মানুষকে প্রেরণা দেয়, শক্তি দেয়, আর সততা মানুষকে চিরকাল বঁচিয়ে রাখে এমন প্রেরণার সম্ভার সেদিন তার জীবনের গল্পেও পেয়েছিলাম। সুযোগ, সামর্থ্য সবকিছু থাকা সত্ত্বেও নিজের মাতৃভূমির মায়া ছেড়ে অনিহা বোধ করেন এ আলোকচিত্রের কিংবদন্তি।
————————-
লেখক: মোহাম্মদ আবদুল্লাহ মজুমদার
শিক্ষার্থী, টেলিভিশন, ফিল্ম অ্যান্ড ফটোগ্রাফি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ।