হাইপারলুপ ট্রান্সপোর্টেশন টেকনোলজিফরাসি লেখক জুল ভার্ন (১৮২৮-১৯০৫) সেই উনিশ শতকে তাঁর কল্পকাহিনিতে বেলুনে চড়িয়ে মানুষকে আকাশ ভ্রমণের স্বাদ দিয়েছিলেন, রকেটে করে চাঁদে পাঠিয়েছিলেন। গল্প বলার ছলে ৮০ দিনে পৃথিবী ভ্রমণের কথাও বলেছেন। তখন অনেকেই তা ‘পাগলের প্রলাপ’ বলে অবজ্ঞা করেছিলেন। প্রকাশকেরা এমন সব ‘অতি অবাস্তব’ কাহিনি প্রকাশে অনীহা দেখিয়ে তাঁকে ফিরিয়ে দিতে দ্বিধা করেননি। অথচ গত ১০০ বছরেই মানুষ সেই সব অতি অবাস্তবকে বাস্তবে পরিণত করেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এরও বেশি এগিয়ে গেছে মানুষ। আগামী ১০০ বছরের মধ্যে মানুষ গ্রহ থেকে গ্রহে ঘুরে বেড়াবে। সখ্য ও হৃদ্যতা গড়ে তুলবে ভিনগ্রহে বসবাসকারীদের সঙ্গে। সময়কে জয় করবে।
আগামী ১০ বছরে যা হবে
১০০ বছরের কথা আপাতত থাক। আগামী ১০ বছরে মহাকাশযাত্রার নতুন মাত্রার সঙ্গে পৃথিবীর যোগাযোগব্যবস্থা বদলে যাবে অনেকখানি। ২০৩০ সালে প্রথমবারের মতো শহরে মানুষের সংখ্যা গ্রামের তুলনায় বেশি হবে। সেদিকে খেয়াল রেখে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সৌরবিদ্যুতে চালিত চালকবিহীন বা স্বয়ংক্রিয় এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংযোজিত ক্যাপসুল বা পড উদ্ভাবনে এগিয়ে আছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংযোজিত, পরিবেশবান্ধব, সময় ও খরচসাশ্রয়ী এমন যাত্রীবাহী দৃষ্টিনন্দন ক্যাপসুল দেখা যাবে বিভিন্ন শহরের আকাশে। গণপরিবহনকে আরামদায়ক ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করতে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইতালি, চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর কিংবা তানজানিয়ার শহরগুলোতে অচিরেই দেখা যাবে অত্যাধুনিক যানবাহন। হালকা রেললাইনের মতো পাতের ওপর কিংবা মাথার ওপরে সুউচ্চ অট্টালিকা পাশ কাটিয়ে শক্ত ধাতুর তার বেয়ে নিঃশব্দে যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে ওই শহরগুলোতে। ব্রিটিশ স্টার্ট-আপ আরবান মাস এবং বেলারুশের স্কাই ওয়ে প্রতিষ্ঠান দুটি এমন ক্যাপসুল তৈরিতে অনেকখানি এগিয়ে গেছে।
এখন যেখানে বছরে আকাশপথে ভ্রমণ করে ২৯০ কোটি মানুষ, সেখানে ২০৩২ সাল নাগাদ আকাশপথের যাত্রী হবে ৬৭০ কোটি। তাই অচিরেই আকাশে পৃথিবীর কক্ষপথ ধরে দ্রুত ভ্রমণের জন্য জ্বালানি ও ইঞ্জিনে আমূল পরিবর্তন ঘটবে।
এয়ারবাস, ইউরোপীয় বিমান নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান
জ্বালানির ধরন বদলে যাবে
২০৩০ সালের দিকে সব ধরনের গাড়ির চালকের আসন অনেকটা চলে যাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দখলে। পরিবেশের কথা বিশেষ বিবেচনায় নিয়ে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে এনে ‘সবুজ জ্বালানি’কে প্রাধান্য দিচ্ছে সবাই। এ জন্য গাড়ি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিদ্যুৎ, সৌরশক্তি আর হাইড্রোজেনের ব্যবহার নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর।
তৈরি হবে হাইপারলুপ
বহু দেশেই চালু হতে যাচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উচ্চ প্রযুক্তিনির্ভর হাইপারলুপ প্রযুক্তি। এতে বায়ুশূন্য একটি টিউবের মধ্যে ক্যাপসুলে করে ভ্রমণ করবে যাত্রীরা, গ্রাহকদের কাছে দ্রুত পৌঁছে দেওয়া যাবে পণ্যসম্ভার। কোনো প্রকার ঘর্ষণশক্তি উৎপন্ন হবে না এবং কাঙ্ক্ষিত গতি পাওয়া যাবে। টিউবের মধ্যে ক্যাপসুলের গতি হবে সুপারসনিক অর্থাৎ শব্দের গতির চেয়েও বেশি—ঘণ্টায় ৭৫০ মাইল বা ১ হাজার ২৫০ কিলোমিটার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, কানাডা এবং ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ হাইপারলুপের প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছে।
ভবিষ্যতের বিমান
এদিকে এয়ারবাস নামের ফরাসি প্রতিষ্ঠানটি যাত্রীদের খুব সংক্ষিপ্ত সময়ে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে ইতিমধ্যে তাদের নতুন নকশার দৃষ্টিনন্দন বিমানের তিনটি প্রোটোটাইপ উন্মুক্ত করেছে। বিশেষ করে এয়ারবাসের ব্লেনডেড-উইং বডি সম্পূর্ণ নতুন নকশার বিমান—এটি অনেকটা শাপলাপাতা মাছের আদলে তৈরি হবে। দূরপাল্লার এমন বিমানের দুপাশের ডানার মধ্যেও থাকবে যাত্রীদের জন্য আরামদায়ক আসন। প্রতিবার ২০০ জন যাত্রী বহনে সক্ষম এ পরিবেশবান্ধব বিমানটি ২০৩০ সাল থেকে আকাশ দখল করবে বলে জানিয়েছে এয়ারবাস। যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং, স্টার্ট-আপ এক্সসোনিক এবং হের্মেউস এযাবৎকালের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়ার পাঁয়তারা করছে। তারা ২০২৫ সালে শব্দের গতির চেয়ে পাঁচ গুণ দ্রুত অর্থাৎ ঘণ্টায় ৬ হাজার ২০০ কিলোমিটার বা ৩ হাজার ৯০০ মাইল গতিতে প্রতিবার ৯০ জন যাত্রীকে মাত্র ৯০ মিনিটে নিউইয়র্ক থেকে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে লন্ডনে পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।
১০০ বছর আগে জুল ভার্নের ৮০ দিনে পৃথিবী ভ্রমণের কথা শুনে তখনকার মানুষেরা খুব বিস্মিত হয়েছিল। অথচ আজকের দিনের স্মার্ট মানুষেরা বলছে, ভবিষ্যতে ৮০ মিনিটে পৃথিবী ঘুরে আসা সম্ভব।