” জিম্বাবুয়ের পেস বান্ধব উইকেটে মাত্র দু’জন ফাস্ট বোলার “
মুহা. ইকবাল আজাদ, ক্রীড়া সম্পাদক।
টেস্ট ফরম্যাট ক্রিকেটের সৌন্দর্য হিসেবে বিবেচিত। ধৈর্য, দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা, কব্জির ব্যবহার, পায়ের চালনা- সবকিছুর মিশিলে তৈরি হয় একজন টেস্ট ব্যাটসম্যান। বিশ্ব ক্রিকেটে যে দল টেস্ট সংস্করণে যত বেশি উন্নতি করেছে, পর্যায়ক্রমে তারাই বিশ্ব দরবারে নিজেদের শির উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ টেস্ট সংস্করণের নিতান্তই ছোট দল৷ বয়সের বিচারে নয় বরং কর্মের ফলাফলে ছোট দল হিসেবে বিবেচিত। অভিষেকের দুই দশক পার হয়ে গেলেও বাংলাদেশ যেন এখনো ‘লার্নিং পয়েন্ট’ অধ্যায়ে অধ্যয়ন করছে। শতাধিক টেস্ট খেলেও এখনো পাস মার্ক তুলতে পারেনি টিম বাংলাদেশ। দিনশেষে র্যাংঙ্কিয়ের তলানি আর দর্শকদের গ্লানি নিয়েই বারংবার ঘরে ফিরছে লাল সবুজের ক্রিকেট দল।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের টেস্ট ম্যাচের সংখ্যা বেশ কম। কালেভদ্রে যে ক’টা ম্যাচের দেখা মেলে, তাতে না থাকে প্রস্তুতির ঝালাই, না থাকে সামর্থ্যের প্রমাণ। ম্যাচ শেষে ম্যানেজমেন্ট, নির্বাচক , কোচ, অধিনায়ক- সবার মুখে মুখস্ত বুলি, ‘আমরা এই ম্যাচ থেকে অনেক কিছু শিখেছি।’ আদতে কী তারা কিছু শিখছে? শেখার জন্য নির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা করেছে? ভুলগুলো শুধরানো নিয়ে কাজ করেছে? টেস্ট স্পেশালিষ্ট খেলোয়াড়দের পরিপূর্ণ মর্যাদা কি দিতে পারছে? ঘরোয়াতে টেস্ট বান্ধব কোন পরিবেশ তৈরি করেতে পেরেছে? উত্তর যদি হয় নিষ্ফলা। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, কবে টেস্ট খেলা শিখবে বাংলাদেশ? কবে পরিকল্পনামাফিক দল গোছানো শিখবে টিম ম্যানেজমেন্ট?
সর্বশেষ শ্রীলঙ্কা সফরে টেস্ট সিরিজ হেরেছে বাংলাদেশ টেস্ট দল। তার আগে বিদেশের মাটিতে রয়েছে একাধিক ইনিংস ব্যবধানে হারের লজ্জার রেকর্ড। দেশের মাটিতে আফগানিস্তানের সাথে নাকানিচুবানি খেয়েছিলো সাকিবের দল। কয়েকমাস আগে ঘরের মাটিতেই আনকোরা ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্টে হোয়াইটওয়াশ হয় বাংলাদেশ। তাতে উপর মহল কিছুটা নড়েচড়ে বসে। সভাপতির কণ্ঠে ফাস্ট বোলারদের নিয়ে আশার বাণী ফুটে। প্রতিফল হিসেবে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে স্পিন পিচে তিন পেসার নিয়ে খেলে মমিনুল বাহিনী। মরা পিচেও গতির ঝলক দেখিয়েছিলেন তাসকিন। কিন্তু একটা সিরিজ পরেই আশার বাণী চুপসে যায়। আবার পুরনো রোগে ম্যানেজমেন্টে হায় হায়! জিম্বাবুয়ের পেস সহায়ক পিসে মাত্র দু’জন ফাস্ট বোলার নিয়ে মাঠে নামে টিম বাংলাদেশ। বিতর্ক উঠে, ম্যানেজমেন্ট কি আসলেই টেস্টের মর্ম বুঝে? নাকি অভিনয়ে পার করে সময়?
‘প্রতিটি ম্যাচ জিততেই মাঠে নামে বাংলাদেশ টেস্ট দল’- গত সিরিজ শেষে এমনটাই বলেছিলেন হেড কোচ রাসেল ডোমিঙ্গো। আসলেই কি জিততে নামে বাংলাদেশ? পরিকল্পনার দিকে তাকালে ডোমিঙ্গোর ভাষা মলিন হয়ে যায়। খেলোয়াড় নিবার্চনের অপেশাদারিত্ব আলোচনার জন্ম দেয়। টেস্ট ম্যাচ জেতার মূল শর্ত হলো, প্রতিপক্ষের ২০ উইকেট লাভ। বাংলাদেশের বোলাররা শেষ ১০ ম্যাচে কয়বার প্রতিপক্ষের ২০ উইকেট তুলতে পেরেছে? চোখে চোখ রেখে বিপক্ষের দলের ক’জনকে ভূপাতিত করেছে? উত্তরেই ফুটে উঠে বিগত টেস্ট ম্যাচের ফলাফল। প্রশ্ন থেকে যায়, এই ব্যর্থতার দায় শুধুই কি বোলারের? জবাবে অবশ্যই আঙুল উঠবে দলের ব্যবস্থাপনা বরাবর। কন্ডিশন বুঝে বোলার ব্যবহারের ব্যর্থতা কর্তারা করতে পারবেন কি অস্বীকার?
আধুনিক ক্রিকেটে ডানহাতি-বামহাতি ব্যাটসম্যানের প্রচলন বেশ ছড়িয়েছে। উন্নত দেশগুলো ডান-বামের মিশিলে স্কোয়াড সাজাচ্ছে। আধুনিকতায় গা ভাসিয়েছে বাংলাদেশ দলও। ওপেনিং জুটিতে কোচের ডানহাতি-বামহাতি ব্যাটসম্যান যেন অত্যাবশকীয়। স্থায়ী তামিমের সাথে চাই ডানহাতি কেউ। তাতে ব্যাটসম্যানের দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তার সামর্থ্য নিয়ে পরীক্ষা হয় না। খেলার টেকনিক নিয়ে প্রশ্ন উঠে না। আধুনিক জুটি মিললেই যেন হয়ে গেলো দল। প্রতিভাবান অন্য কোন বাহাতি ব্যাটসম্যান থাকলেও তামিমের সঙ্গী হিসেবে তার যোগ্যতা যেন নস্যি। অথচ পরিসংখ্যান বলে, ওপেনিং জুটিতে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ স্কোরের উভয় মালিক ছিলেন বামহাতি। আধুনিকতায় ঝুঁকতে গিয়ে বারবার ভুলের মাশুল দিয়েও শিক্ষা হচ্ছে না ম্যানেজমেন্টের। তবুও আনকোরা ডানহাতি ব্যাটসম্যানকে একাধিকবার সুযোগ দেওয়া চাই। তাতে দলের কি হলো হাল; দেখার বালাই নাই।
গা-ছাড়া ভাব আর স্বেচ্ছাচারী চিন্তাভাবনায় টেস্ট ম্যাচ খেলা যায়, কিন্তু জেতার কল্পনাও করা যায় না। ক্রিকেটীয় শিল্পকে নিজের করে নিতে চাই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। এর গুরুদায়িত্বের ভারটা অবশ্যই ম্যানেজমেন্টকে সামলাতে হবে। কন্ডিশন বুঝে স্কোয়াড ঘোষণা। বাড়তি পেসার, স্পিনার কিংবা ব্যাটসম্যান নেওয়ার পরিকল্পনা। আধুনিকতা নয় বরং দক্ষতা, অভিজ্ঞতা অনুযায়ী খেলোয়াড় নির্বাচন। কোচের ইচ্ছে নয়, বুদ্ধিমত্তার বিচারে স্কোয়াড গঠন। সবগুলো দায়িত্ব ম্যানেজমেন্টকেই শক্ত হাতে প্রণয়ন করতে হবে। টেস্ট ক্রিকেটে ফাস্ট বোলারদের ভূমিকা অপরিসীম। দেশে এবং দেশের বাহিরে একাধিক ফাস্ট বোলার খেলানোর মানসিকতা তৈরি করতে হবে। ইউরোপীয় দেশগুলোতে বোলারদের ভালো করতে সেই পরিবেশের পিস নিশ্চিত করতে হবে। নামের বিচারে নয়, বরং দক্ষতা, ভেরিয়শনের মুগ্ধতায় স্পিনার নির্বাচন করতে হবে। একটা ইনিংস খারাপ করায় কোন ব্যাটসম্যান বা বোলারকে বাদ দেওয়ার প্রথা বিলুপ্ত করতে হবে। বারংবার ব্যর্থ হওয়া খেলোয়াড়ের বোঝা না টেনে বিকল্পে চোখ রাখতে হবে।
টেস্টে ভালো করতে ঘরোয়া ক্রিকেটের মান বৃদ্ধি করার বিকল্প নেই। প্রয়োজনে একাধিক টুর্নামেন্ট চালু করতে হবে। স্পেশালিষ্ট টেস্ট খেলোয়াড়দের আলাদা করে সুযোগ সুবিধা এবং মর্যাদা দিতে হবে।
ম্যানেজমেন্টের দুরদর্শিতার সাথে খেলোয়াড়দের মাঠের কর্মফল একটি দলকে সত্যিকার অর্থে টেস্ট ম্যাচ জেতা শেখাবে।