জুলিয়াস সিজার তালুকদার :
বিশ্ববিদ্যালয়সহ যে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরই প্রধান সম্পদ উক্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাই। শিক্ষার্থীই সম্পদ স্লোগানটিই সর্ববিদ্যাপীঠে প্রযোজ্য। ১৯২১ সালে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ব্রিটিশ ভারতে প্রতিষ্ঠিত হয় তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় – আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়, লক্ষ্ণৌ বিশ্ববিদ্যালয় ও আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনেই রয়েছে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও প্রতিষ্ঠার পর হতেই রাজনীতি চর্চার উর্বর ক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। আলিগড় থেকে হয়েছে পাকিস্তান আন্দোলন আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম৷
যে বিদ্যাপীঠগুলো রাজনীতির কৃষ্টি কেন্দ্র, যেখানে জনতার অধিকারের কথা বলা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনন্য। পূর্ববঙ্গীয় জনগণের অধিকার রক্ষার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রাতিষ্ঠানিক অর্জন হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার দায় স্বীকার করেছে পূর্ববঙ্গীয় জনগণের জন্য মেধা, মনন ও রক্ত দিয়ে। এই পূর্ববঙ্গকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা এনে দিয়েছে।
এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন ও সবচেয়ে বনেদি ছাত্রাবাসের নাম ‘মহামেডান হল বা মুসলিম হল’- যা পরে ১৯৩১ সালে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল সংক্ষেপে এস এম হল নামে প্রতিষ্ঠা ও পরিচিতি লাভ করেছে।
তিনটি প্রতিষ্ঠাকালীন হলের মধ্যে এস এম হল একটি কিন্তু নানা কারণেই এই হলকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান হলের মর্যাদা দেয়া যেতে পারে৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ভূমিকার বিষয়টি বোধ হয় এস এম হল পরিবারই সবার আগে অনুভব করতে পেরেছিল,হয়তো এস এম হলের ছাত্রদের আগামীর জন্য প্রস্তুত করতেই গণতান্ত্রিক ছাত্র রাজনীতি চর্চার প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা শুরু হয়েছিল। এই প্রস্তুত করার দায়িত্বে অভিভাবক নামক বটবৃক্ষ ছিলেন স্যার এ এফ রহমান, তাঁর পুরো নাম আহমেদ ফজলুর রহমান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পর তাকে উপাচার্য স্যার পি জে হার্টস এস এম হলের প্রাধ্যক্ষ বা প্রভোষ্ট নিয়োগ করেন। স্যার পি জে হার্টসের ইচ্ছায় তিনি হলে ছাত্র সংসদ গঠনে উদ্যোগী হন এবং আত্মপ্রকাশ করে ‘মুসলিম হল ইউনিয়ন সোসাইটি’, পরে সোসাইটি শব্দটি বাদ দেয়া হয়। ছাত্র অধিকার রক্ষা, নেতৃত্ব বিকাশ, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার বাতিঘর হিসেবে এই মুসলিম হল ইউনিয়নই অন্যান্য হল ছাত্র সংসদ বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-ডাকসু গঠনে পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে। বর্তমানে এই সংসদের পুরো নাম ‘সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্র সংসদ’।
সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্র সংসদ গঠনে স্যার এ এফ রহমানই প্রতিষ্ঠাতার ভূমিকা পালন করেন এবং মাত্র দেড় মাসের মধ্যেই গড়ে তোলেন একটি পূর্ণ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ। প্রথম নির্বাচনটিই হয় ব্যাপক প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক যাতে সহ-সভাপতি (ভিপি) পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন আবদুল আজিজ, রহিমউদ্দিন শাহ ও সৈয়দ আলী এবং সাধারণ সম্পাদক পদে মিজানুর রহমান, নেফাজউদ্দিন খান ও আশরাফ উদ্দিন আহমদ। উক্ত নির্বাচনে বিজয়ী হন আবদুল আজিজ- মিজানুর রহমান।
এই আজিজ-মিজান সংসদকে বরণ করতে ১৯২১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর নবাবি কায়দায় এক জমকালো অভিষেক অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। সে আরেক বর্ণাঢ্য অধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে। অভিষেক অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন হল প্রাধ্যক্ষ ও ছাত্র সংসদ সভাপতি স্যার এ এফ রহমান, প্রধান অতিথির আসন অলঙ্কৃত করেন উপাচার্য স্যার পি জে হার্টস, বক্তৃতা করেন হাউজ টিউটর ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, ইতিহাসবিদ আর সি মজুমদার ও ঢাকা হলের ( বর্তমান শহীদুল্লাহ্ হল) প্রাধ্যক্ষ জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এস এম হল ছাত্র সংসদের অভিষেক অনুষ্ঠানটিই ছিল প্রথম আনন্দঘন মহোৎসব। এই অনুষ্ঠানটিকে যেন প্রকৃতিও বরণ করেছিল অকৃপণভাবে, আশ্বিনের মেঘমুক্ত, জ্যোৎস্নাস্নাত দিনের অনুষ্ঠান চলেছিল রাতে প্রায় সাড়ে দশটা পর্যন্ত।
উক্ত অভিষেক অনুষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ অতিথি যথাক্রমে আর সি মজুমদার জগন্নাথ হলে এবং জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ ঢাকা হলে ছাত্র সংসদ প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ গঠিত হয় আরো পরে ১৯২৪ সালে।
এস এম হল ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমার সীমাবদ্ধতা, অদক্ষতা থাকা সত্ত্বেও আমি আত্মবিশ্বাসী, পরিবর্তনকামী ও উদ্যমী। আমার হলের সাধারণ ছাত্রদের সহযোগিতা ও সমর্থনে আমার মেয়াদকালে আমাদের গৌরব পুনঃপ্রচলনে সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করছি।
লেখক : জি.এস, ছাত্র সংসদ, এস.এম হল।
#S_M_Hall_History
#Dhaka_University_Pioneers