সোহাগ মনি, কুবি :
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার। ভাষা শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে নির্মিত হলেও এই শহীদ মিনার হয়ে উঠেছে অনৈতিক কাজের আখড়া। প্রশাসনের উদাসীনতায় শহীদ মিনারে চলছে উচ্চস্বরে হিন্দি আর ইংরেজি গান বাজিয়ে রাতভর শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠান উদযাপন থেকে শুরু করে মাদক গ্রহন সহ অসামাজিক কার্যকলাপ। ব্যক্তিগত ভাবে বেলুন- ফেস্টুনে সাজিয়ে প্রিয়জনের জন্মদিন উদযাপন সবই হরদম চলছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ( কুবি) শহীদ মিনারে। দিন দিন শহীদ মিনার হয়ে উঠেছে ব্যক্তিগত উদযাপনের রঙ্গমঞ্চ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিম পাশের একদম শেষ প্রান্তে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারটির অবস্থান। বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিম পাশটি এখনো অরক্ষিত থাকায় দিনের বেলায় গবাদিপশু আর আঁধার নামলেই বহিরাগত ও অভ্যন্তরীন মাদকসেবীর অবাধ বিচরণক্ষেত্রে পরিণত হয় এই গুরুত্বপূর্ন স্থানটি। এই সমস্যা সমাধানে কিছুদিন আগে শহীদ মিনারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে লাইটিং এর ব্যবস্থা করা হলে বিচরণ বাড়ে ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের। ফলে সন্ধ্যার পর মাদকসেবীদের আনাগোনা কিছুটা কমে আসে। কিন্তু রাত একটু গভীর হলেই আবারো শুরু হয় মাদকসেবীদের আনাগোনা।
এদিকে শিক্ষার্থীদের বিচরণ বাড়লেও শহীদ মিনারের রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা পবিত্রতা রক্ষায় নেয়া হয়নি কোনো পদক্ষেপ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন শিক্ষার্থীরা এ বিষয়ে প্রকাশ করেছেন উদ্বেগ ও ক্ষোভ।
এ প্রসঙ্গে ক্ষোভ প্রকাশ করে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের দশম ব্যাচের শিক্ষার্থী ফয়সাল হাসান বলেন, ‘শহীদ মিনার জাতির আবেগের জায়গা। শহীদদের স্মরণ ব্যতীত ব্যক্তিগত উদযাপন, নিজের মতো করে শহীদ মিনারকে সাজানো, বা পার্টি করার কাজে ব্যবহার করে শহীদ মিনারকে নোংরা করে ফেলে রাখা অনুচিত। এতে শহীদদের প্রতি অসম্মান করা হয়।‘
শুধু জন্মদিন উদযাপনই নয়, শহীদ মিনারটিতে উচ্চস্বরে ভিন্ন সংস্কৃতির গান বাজিয়ে, আতশবাজি পুড়িয়ে শিক্ষা সমাপনী দিবস (র্যাগ ডে) উদযাপনের অভিযোগও আছে। গত ২২ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট একটি বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠান আয়োজন করে। সন্ধ্যা থেকে শুরু হওয়া তাদের এই অনুষ্ঠানে তারা শহীদ মিনারকে বেলুন-ফেস্টুনে সাজায়, মূল স্তম্ভে লাগায় ব্যানারও। শুধু তাই নয়, সন্ধ্যা থেকেই হিন্দি আর ইংরেজি গান বাজিয়ে শহীদ মিনারের বেদীতে নাচানাচি আর হৈ-হুল্লোড়ে মত্ত হয় তারা। অনুষ্ঠানের শেষে আতশবাজি পোড়ানো হয়। তাদের অনুষ্ঠান শেষে দেখা যায়, শহীদ মিনারের মূল বেদী জুড়ে পড়ে আছে আতশবাজির পোড়া কাগজ, বাদামের খোসা, সিগারেটের ফিল্টার, ঝুলছে বেলুন।
শহীদ মিনারের এমন ব্যক্তিগত ব্যবহার প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুহাম্মদ সোহরাব উদ্দীন বলেন, ‘বাইরের কেউ নয় বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই শহীদ মিনারকে এভাবে ব্যবহার করছে। শহীদ মিনার এমন একটি স্থাপনা যেটা আমাদের অস্তিত্বের ইতিহাস ও বোধ ধারন করে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা যদি শহীদ মিনারে এসে ভিন্ন সংস্কৃতির গান বাজিয়ে নাচানাচি করে তবে সেখানে শহীদ মিনারের মর্যাদা ক্ষুন্ন করা হয়। আমাদের জাতীয়তাবাবোধের যে অভাব সেই অভাবের কারণেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থীদের দ্বারা এসব হচ্ছে।‘
বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক-শিক্ষার্থী জানান, শহীদ মিনারকে উদযাপনের মঞ্চ হিসেবে ব্যবহারের ধারাটি বেশ শক্তভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। তারা মনে করছেন, বারবার এসব হওয়ার পরও প্রশাসনের পক্ষ থকে দৃশ্যমান কোনো নির্দেশনা না আসা এবং শহীদ মিনারটির রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তার জন্য কোনো কর্মী না থাকায় এসব হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর কাজী মোঃ কামালউদ্দিন বলেন, ‘শহীদ মিনারে শিক্ষার্থীরা যাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু শহীদ মিনারে যদি কেউ আমাদের সংস্কৃতি-ঐতিহ্য ধারণ করেনা ও শহীদদের ত্যাগের প্রতি অবমাননামূলক কিংবা অসামাজিক কোনো কাজ করে থাকে তবে অবশ্যই আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো। গঠন মূলক যে কোনো কাজ যা ভাষা, স্বাধীনতা ও স্বাজত্যবোধ ধারন করে সেগুলো করার জন্য আমরা অনুষ্ঠানসূচী দেখে অনুমতি দেই। কিন্তু, জন্মদিন বা র্যাগ ডে উদযাপনের জন্য কখনোই নয়।‘