--এডভোকেট মোঃ সাইফুদ্দীন খালেদ
একটি দুর্ঘটনা আজীবনের কান্না- এ স্লোগান ব্যবহার হয় সড়কপথে দুর্ঘটনা বিষয়ে জনগণকে সচেতন করার জন্য। পত্রিকা খুললে যে খবর গুলো সব থেকে বেশি শিহরিত করে তুলে তা হচ্ছে বিভিন্ন মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনার খবর। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ঘটাচ্ছে দেশের বিভিন্ন সড়কগুলোতে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, এ বছরের প্রথম তিন মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় সারা দেশে মারা গেছে ১ হাজার ১৬৩ জন। সড়ক বাড়ছে, গাড়ি বাড়ছে চালক তো বাড়ছে না। বিআরটিএর তথ্য হলো দেশে বর্তমানে অনুমোদিত গাড়ির সংখ্যা ৩৪ লাখ। লাইসেন্স প্রাপ্ত চালক আছে ১৭ লাখ। একটা গাড়ি দিন-রাত একজনে চালালেও ১৭ লাখ চালকের ঘাটতি আছে। প্রতি বৎসর চালকের চাহিদা রয়েছে ৩০-৩৫ হাজার। এখন পর্যন্ত বছরে নুতন চালক যুক্ত হচ্ছে ৩-৫ হাজার। আমাদের দেশে চালক সৃষ্টির কোনো পরিকল্পিত উদ্যোগ বা প্রতিষ্ঠান নেই। অনুমোদনহীন, অদক্ষ প্রশিক্ষক দ্বারা পরিচালিত কিছু ট্রেনিং স্কুল আছে। যা চালক সৃষ্টি হচ্ছে স্ব উদ্যোগেই সৃষ্টি হচ্ছে। গ্রাম থেকে উঠে আসা বেকার তরুণেরা টার্মিনালে, স্ট্যান্ডে ঘোরাঘুরি করে। ৫/১০ টাকার বিনিময়ে গাড়ি ধোয়ামোছা করে। কোন সময় গাড়ির সহকারীর অর্বতমানে যাত্রী ডাকে, গাড়িতে উঠে। শখ করে স্টিয়ারিং ধরে। রাস্তায় প্রতিদিন যে অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটে, তার সবকিছুর জন্য শুধু চালকরাও দায়ী নয়। কেননা, বিআরটিএ’র ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়ার প্রক্রিয়ায় যদি ত্রুটি থাকে, যদি তারা অদক্ষ লোককে লাইসেন্স দেয় এবং সেই ড্রাইভার যদি দুর্ঘটনার কারণ হন, তাহলে তার দায় কি বিআরটিএ’র নয়? নিরাপদ সড়কের দাবীতে ২০১৮ সালের আগস্টে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছিল। সেই পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় সংসদে সড়ক পরিবহণ আইন ২০১৮ পাস হয়। নতুন সড়ক পরিবহন আইনে জরিমানা ও বিভিন্ন অপরাধে শাস্তি বাড়ানো হয়েছে। সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ এ মোটরযান চলাচলের নির্দেশাবলী দেওয়া হয়েছে। উক্ত আইনের ৪৯ ধারায় প্রথম অংশে বলা হয়েছে- মদ্যপান বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করে কোন চালক মোটরযান চালাতে পারবেনা। মদ্যপান বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করে কোন কন্ডাক্টর বা মোটরযান শ্রমিক মোটরযানে অবস্থান করতে পারবেনা। মোটরযান চালক কোন অবস্থাতে কন্ডাক্টর বা মোটরযান শ্রমিককে মোটরযান চালনার দায়িত্ব প্রদান করতে পারবেনা। সড়ক বা মহাসড়কে নির্ধারিত অভিমুখ ব্যতীত বিপরীত দিক হতে মোটরযান চালানো যাবেনা। সড়ক বা মহাসড়কে নির্ধারিত স্থান ব্যতীত অন্যকোন স্থানে বা উল্টো পার্শ্বে বা ভুল দিকে (ডৎড়হম ঝরফব) মোটরযান থামিয়ে যানজট বা অন্যকোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবেনা। চালক ব্যতীত মোটর সাইকেলে একজনের অধিক সহযাত্রী বহন করা যাবেনা এবং চালক ও সহযাত্রী উভয়কে যথাযথ ভাবে হেলমেট ব্যবহার করতে হবে। চলন্ত অবস্থায় চালক, কন্ডাক্টর বা অন্যকোন ব্যক্তি কোন যাত্রীকে মোটরযানে উঠাতে বা নামাতে পারবেনা। প্রতিবন্ধী যাত্রীদের জন্য গণপরিবহণে অনুকূল সুযোগ-সুবিধা রাখতে হবে। মোটরযানের বডির সামনে, পিছনে, উভয়পার্শ্বে, বডির বাহিরে বা ছাদে কোন প্রকার যাত্রী বা পণ্য বা মালামাল বহন করা যাবেনা। সরকার বা কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ব্যতীত কোন মোটরযানে বিজ্ঞাপন প্রদর্শন বা প্রচার করা যাবেনা। কোন মহাসড়ক, সড়ক, ফুটপাত, ওভারপাস বা আন্ডারপাসে মোটরযান মেরামতের নামে যন্ত্রাংশ বা মালামাল রেখে বা দোকান বসিয়ে বা অন্য কোনভাবে দ্রব্যাদি রেখে যানবাহন বা পথচারী চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা যাবেনা। সড়কের সংলগ্ন ফুটপাতের উপর দিয়ে কোন প্রকার মোটরযান চলাচল করতে পারবেনা। কোন ব্যক্তি কোন মোটরযানের মালিক বা কোন আইনানুগ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতীত সংশ্লিষ্ট মোটরযান চালিয়ে বাইরে নিয়ে যেতে পারবেনা। আইনানুগ কর্তৃপক্ষ বা যুক্তিসংগত কারণ ব্যতীত কোন ব্যক্তি দাঁড়িয়ে থাকা কোন মোটরযানে প্রবেশ বা আরোহণ করতে পারবেনা। দ্বিতীয় অংশঃ মোটরযান চালক মোটরযান চালনারত অবস্থায় মোবাইল ফোন বা অনুরূপ সরঞ্জাম ব্যবহার করতে পারবেনা। মোটরযান চালক সিটবেল্ট বাঁধা ব্যতীত মোটরযান চালাতে পারবেনা। দূরপাল্লার মোটরযানে নির্ধারিত সংখ্যক যাত্রী বা আরোহীর অতিরিক্ত কোন যাত্রী আরোহী বহন করা যাবেনা। কোন চালক, কমান্ডার বা মোটরযান পরিচালনার সংশ্লিষ্ট কোন ব্যক্তি পরিবহনযানে যাত্রী সাধারণের সাথে কোন প্রকার দূর্ব্যবহার বা অসৌজন্যমূলক আচরণ বা হয়রানি করতে পারবেনা। রাত্রি বেলায় বিপরীত দিক হতে আগত মোটরযান চালনায় বিঘ্ন সৃষ্টি হয় এরূপ হাইবিম ব্যবহার করে মোটরযান চালানো যাবেনা। উপরোক্ত নির্দেশাবলী সমূহ অমান্য করলে শাস্তির বিধান রয়েছে। প্রথম অংশের কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক ৩(তিন) মাসের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং চালকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হিসাবে দোষ সূচক এক পয়েন্ট কর্তন হবে। দ্বিতীয় অংশের কোন বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক ১(এক) মাসের কারাদণ্ড বা ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং চালকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হিসাবে দোষ সূচক এক পয়েন্ট কর্তন হবে। সড়ক পরিবহন আইনে বলা আছে, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হত্যার উদ্দেশ্যে প্রমাণিত হলে তা দণ্ডবিধি ১৮৬০এর ৩০২ ধারার অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে, যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। কোনো ব্যক্তির ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকলে বা মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স ব্যবহার করে গাড়ি চালালে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হবে। সড়কে দুটি গাড়ি পাল্লা দিয়ে (রেসিং) চালানোর সময় যদি দুর্ঘটনা ঘটে, সে ক্ষেত্রে তিন বছরের কারাদণ্ড অথবা ২৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। চলন্ত অবস্থায় চালক মুঠোফোনে কথা বললে এক মাসের কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। এই আইনে অপরাধের তদন্ত, বিচার, আপিল ইত্যাদি ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধি প্রযোজ্য হবে। ফলে আইনটি কার্যকর হলে বেপরোয়া চালানো, অবৈধ লাইসেন্সধারী চালকদের দৌরাত্ম্য কমত। কিন্তু আইন পাশের দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হলেও বাস্তবায়ন হয়নি। সড়ক পরিবহণ আইন বাস্তবায়ন না করে সড়কে শৃঙ্খলা এনে দুর্ঘটনা রোধে কমিটি প্রণীত সুপারিশযুক্ত প্রতিবেদনে আশু করনীয় ৫০টি, স্বল্পমেয়াদী ৩২টি এবং দীর্ঘমেয়াদী ২৯টি প্রস্তাব সর্বমোট ১১১টি প্রস্তাব আনা হয়েছে। এসব সুপারিশ বাস্তবায়িত করতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হতে পারে আর কতটুকু কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়ে গেছে। সড়ক দুর্ঘটনার আরো বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে; কারণগুলোর মধ্যে রাস্তার ব্ল্যাকস্পট (ক্রটি), অদক্ষ চালক, সড়কের তুলনায় গাড়ির সংখ্যা বেশি, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, রাস্তার জ্যামিতিক ক্রটি, নেশাগ্রস্ত হয়ে গাড়ি চালানো, পথচারী ও যাত্রীদের অসাবধানতা, ডিভাইডারের অভাবে বিপরীতমুখী যানবাহনের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ, রেলের অরক্ষিত লেভেলক্রসিং। অনেক সময় রেলক্রসিং গুলোতে ট্রেনের ধাক্কায় মারা যাচ্ছে মানুষ। দেশের অধিকাংশ রেলক্রসিংয়ে নেই পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা, নেই কোন সঠিক আগাম সংকেতের ব্যবস্থাও। দুর্ঘটনা কবলিত স্থানে দ্রুত চিকিৎসা সাহায্য পৌঁছানো, এম্বুলেন্স, ইমার্জেন্সি সার্ভিস এবং ফার্স্ট এইড টিম সংক্রান্ত ব্যাপারগুলো দেশে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। হাইওয়েগুলোতে পুলিশের পেট্রোল কারের সংখ্যাও নগণ্য। গাড়ির সিটবেল্ট এবং হেলমেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনীহা, ঝুঁকিপূর্ণ গতিতে গাড়ী ওভারটেক করা, ট্রাফিক আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা ইত্যাদি। এসব কারণে সড়ক দুর্ঘটনা এখন অন্যতম জাতীয় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এই সমস্যা থেকে মানুষজনকে মুক্ত রাখার সার্বিক পদক্ষেপ গ্রহণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখা জরুরী। যানবাহনের উচ্চগতি দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে। জেব্রা ক্রসিং ও ফুট ওভারব্রিজ ছাড়া রাস্তা পারাপার বন্ধ করতে হবে। পাঠ্য পুস্তকের সিলেবাসেও সড়ক দুর্ঘটনার কারণ, প্রতিরোধ সংক্রান্ত সচেতনতামূলক প্রবন্ধ, গল্প অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। চালকদের সচেতনতা বৃদ্ধিসহ বিআরটিএ'র উদ্যোগে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। ট্রাকে ওভারলোড বন্ধে প্রয়োজনীয় সংখ্যক (ওয়েয়িং) মেশিন চালু করা এবং ওভারলোডের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা চালু করতে হবে। বিভিন্ন সড়কের সুনির্দিষ্ট কারণ চিহ্নিত করে দুর্ঘটনাবিরোধী অভিযান চালাতে হবে। সড়ক মেরামত, সংস্কারের মত জরুরী কাজকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে বিভিন্ন গাড়ি ভাংচুর করে আগুন জ্বালিয়ে সাধারন জনতা ক্ষোভ প্রকাশ করলেও তারা ভুলে যাচ্ছে এটা কোনো সঠিক পন্থা নয়। বরং নিজের দেশের সম্পত্তিই বিনষ্ট করা হচ্ছে কিন্তু সঠিক পদক্ষেপ কিংবা সচেতনতা কিছুই হচ্ছেনা। এভাবে চলতে থাকলে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা দিনে দিনে বাড়তে থাকবে। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সরকার এবং জনগণ উভয় ক্ষেত্রেই সহযোগিতা ও সচেতনতা প্রয়োজন। প্রয়োজন ট্রাফিক আইন আইন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান। দেশে উন্নত ট্রাফিক মনিটরিং ব্যবস্থা, উন্নত সড়ক তৈরী, কঠোর ভাবে ফিটনেসবিহীন যানবাহন প্রতিরোধ এবং প্রশিক্ষণবিহীন চালকদের অপসারণ সহ অজস্র জরুরী উদ্যোগ প্রয়োজন। সবার আগে প্রয়োজন সড়কে যানবাহন চলাচল এবং দুর্ঘটনা সংক্রান্ত ব্যাপারগুলোতে আইনের সঠিক প্রয়োগ। কর্তৃপক্ষের সুষ্ঠু, সমন্বিত পদক্ষেপ এবং জনগণের সচেতনতা ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় দেশ দুর্ঘটনামুক্ত হবে এ প্রত্যাশা।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০