–মোহাম্মদ মন্জুরুল আলম চৌধুরী।
দ্রোহের আগুনে জ্বলি বার বার। উচ্চকিত হয়ে উঠে মুষ্টিবদ্ধ দু’হাত। নিমেষেই চোখ পড়ে মাঠির ওপর। দ্রোহের আগুন যায় নিভে। শিথিল হয়ে পড়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত দু’খানি। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। গড়িয়ে পড়ে অশ্রু। ফিরে যেতে হবে একদিন। নিশ্চিত এবং অবধারিত সেই মাটির ঘর। সেই মাটির বিছানায়। কেন আমরা বুঝেও বুঝিনা। মানুষ তুমি কেন করো এতো দম্ভ ? মানুষ তোমার কিসের এত অহংকার ? অহংকার তো শুধু মহান রাব্বুল আলামিনের পক্ষেই সাজে। বান্দার পক্ষে নয় মোটেও। তবুও মানুষ সমাজে অন্যায় অবিচারের শিকার হচ্ছে অহরহ। মিথ্যে দম্ভ অহংকার প্রভাব প্রতিপত্তি ক্ষমতা কতিপয় মানুষকে অন্ধ করে দিয়েছে। পরিণত করেছে মানুষ নামের অমানুষে।
আকাশের কান্না প্রকাশ্য বা দৃশ্যমান। পাশাপাশি কখনো বা তা তর্জন গর্জনসহ ধরণীকে করে সিক্ত। কখনো বা করে প্লাবিত। কিন্তু মানুষের সব কান্না প্রকাশ্য বা দৃশ্যমান নয়। এমন কিছু কান্না আছে যা শুধু নিজের মধ্যে সীমিত থাকে যা অন্যের কাছে প্রকাশ করা যায় না। প্রকাশ করা সম্ভবপরও হয় না। আপনজনেরা যখন কাঁদায় তখন তো কোনমতেই প্রকাশ করা যায় না। অপমান আর লাঞ্চনায় শুধু অব্যক্ত আর অদৃশ্য কান্না পকেটের রুমাল ভিজে যায়। ভিজে যায় বালিশ। শেষ হয়ে যায় টিস্যু বক্স। তবুও যেন শেষ নেই এই বোবা কান্নার।
মানুষের নিকট থেকে শ্রদ্ধা, স্নেহ-মমতা, মায়া, ভালবাসা, সরলতা, উদারতা, সততা, মনুষ্যত্ব, মানবিকতা, মহত্ত্ব, ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য, নৈতিকতা, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও অনুশাসন ক্রমশ লোপ পাচ্ছে। অর্থ-বিত্ত্ব বৈভবের অনাকাঙ্ক্ষিত প্রদর্শন, পরশ্রীকাতরতার, দাম্ভিকতা হিংস্রতা, বাহুবল উগ্র থেকে উগ্রতর হচ্ছে। রাজনৈতিক বা সামাজিক বা আর্থিক বা প্রশাসনিক বা অবৈধ আয়ের উৎসের প্রভাব প্রতিপত্তি নিয়ে ভূমি দস্যুতা, সন্ত্রাস, খুন, গুম, নারী শিশু ধর্ষণ বেড়ে যাচ্ছে সমাজে। আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব বা বিচার হীনতার সংস্কৃতি, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কিছু কিছু ক্ষেত্রে সদিচ্ছার অভাব, কতিপয় সদস্যের নীতি নৈতিকতা, মানবিকতা বিবর্জিত কর্মকাণ্ড, রাজনৈতিক ও আর্থিক প্রভাবের কাছে নতজানু হওয়া, সংঘটিত ঘটনার তদন্তকারী কর্মকর্তার উদাসীনতা বা আইন সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকা ইত্যাদি কারণে সামাজিক, মানবিক, ধর্মীয় অবক্ষয় বা অস্থিরতা বিরাজমান। আমাদের অনেকের মনে একটি ভ্রান্ত ধারণা জন্মে যে এই শক্তি ক্ষমতা দম্ভ থাকবে অনন্তকাল। আমাদের অনেকেরই জীবন যেন অমরণশীল। মরণের শরবত যেন পান করতে হবেনা কোনো দিনও। একটা প্রবাদ আছে — বাঘের বল বার বছর। বয়স বাড়ার সাথে সাথে শক্তিশালী বাঘের যৌবনের শক্তি যখন ক্ষয়ে যায় তখন বাঘের বল বা শক্তি কমে যায়। তখন তার শিকারের পেছনে দৌড়ানোর সেই ক্ষিপ্রতা, গতি, কৌশল ক্রমশ হ্রাস পায়। দিনে দিনে ক্ষয়ে যায় বল বা শক্তি। দিন কাটে তার অর্ধাহারে ,আনাহারে। একদিন বনে যে ছিল শক্তি, হিংস্রতা, ক্ষিপ্রতার মূর্ত প্রতীক সে হয়ে পড়ে অবহেলিত। যার সামনে দিয়ে পশু পাখীরা যেতে ভয় পেত সেই বুড়ো বাঘকে এখন পিঁপড়াও পাত্তা দেয়না। এটাই বাঘের নিয়তি ! হয়তবা বা মানবজাতিরও ।
মানুষের ভেতরে আমি নামক এক পশুর বসবাস। সেই আমি আমাদেরকে আদিমতার দিকে, অসভ্যতার দিকে, হিংসা বিদ্ধেষ ও ঈর্ষার অশুভ দিকে, অমানবিকতার দিকে, প্রচণ্ড ও নীতি নৈতিকতাহীন অর্থ লোলুপতার দিকে, পশুত্বের দিকে, ধর্মের বিপক্ষে টেনে নিয়ে যায়। তবে সবার ভেতর যে এই পশুবৃত্তি কাজ করে তা নয়। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে নফসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়, কেউ বিজয়ী হয় কেউবা পরাজিত হয়। যতক্ষণ না আমাদের ভেতরকার আমিকে নিয়ন্ত্রণ বা কব্জা করতে না পারবো ততক্ষণ পর্যন্ত মনুষ্যত্ব বিপর্যস্ত হয়ে থাকবে যা একটি সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন আজীবন স্বপ্ন হয়েই থাকবে। আসুন না আমরা নিজেরা নিজেদের ঢোল বাজানো বন্ধ করি। আমাদের ভেতরকার পশুত্বকে কুরবানী করি এবং নফসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিজেদেরকে বিজয়ী করি একটা সুখী সুন্দর নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে।
ধন্যবাদান্তে,